কলকাতাঃ হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্য ‘টানা রিকশা’। পৃথিবীর যে ক‘টি শহরে এখনও টানা রিকশা চলে তার মধ্যে কলকাতা অন্যতম।
আফ্রিকার মাদাগাস্কারে এখনও টানা রিকশার চল আছে। অন্যদিকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত টানা রিকশা চলত লস অ্যাঞ্জেলসের রাস্তায়ও। কানাডাতেও অতীতে টানা রিকশা চলত বলে জানা যায়।
বেশিরভাগ শহরেই এ রিকশা অতীত হয়ে গেলেও এতোদিন পর্যন্ত কলকাতায় টিকে ছিল। তবে সরকারি নির্দেশে কিছুদিনের মধ্যেই এ রিকশা অতীত হতে যাচ্ছে। এর বদলে রাজ্য সরকার রিকশা চালকদের হাতে তুলে দেবেন ‘গ্রিন রিকশা’। কারণ সরকারের মতে কলকাতার এই অন্যতম প্রাচীন যানটি ‘অমানবিক’।
বিগত বাম সরকারই নিষিদ্ধ করেছিল এটি। তারপরও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কলকাতায় রাস্তায় এতোদিন চলেছে এ রিকশা।
বাতিল হয়ে যাবার আগে কলকাতার টানা রিকশার ইতিহাস, বর্তমান এবং রিকশা চালকদের জীবন যাপন নিয়ে সরজমিনে জানতে পথে নেমে ছিল বাংলানিউজ।
কিভাবে কলকাতায় এলো এ রিকশা সে সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য লিপিবদ্ধ নেই। তবে বিখ্যাত লেখক ডোমেনিক ল্যাপিয়ারের লেখা ‘সিটি অফ জয়’ এই হাতে টানা রিকশা চালকদের জীবনের নানা দিকের কথা উল্লেখ আছে।
‘সিটি অফ জয়’ সিনেমাতে প্রখ্যাত অভিনেতা ওম পুরি হাজারি পাল নামে এক হাতে টানা রিকশা চালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বেশ কিছু বইপত্র ঘেঁটে জানা যায় আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে জাপান থেকে কলকাতায় এসেছিল এ রিকশা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় টানা রিকশার ছবি দেখা যায়। সেই সময়ের খবরের কাগজ ও পত্রিকা ঘেঁটে জানা যাচ্ছে ১৯১৪ সালের দিকে ঢাকা শহরেও টানা রিকশা চলত।
‘সিটি অফ জয়’ ছাড়াও ভারতের চলচ্চিত্রে বারবার এসেছে টানা রিকশার কথা। ১৯৫৩ সালে নির্মিত ‘দো বিঘা জমিন”-এ অভিনেতা বলরাজ সাহানি তার সমস্ত জমি বিক্রি করে এসে কলকাতায় রিকশা চালনাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন।
১৯৭৬ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জন অরণ্য’, ১৯৯১ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘আগন্তুক’ অথবা হাল আমলের সাইফ আলি খান এবং সোনাক্ষি সিনহা অভিনীত ‘বুলেট রাজা’ চলচ্চিত্রে বারেবারে এসেছে টানা রিকশার কথা।
এতো গেল চলচ্চিত্রের কথা। যে সময়কে বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ বলা হয় সেই সময়ে বিখ্যাত গান “রিকশা চালাই মোরা রিকশাওয়ালা” বাঙালি শ্রোতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল।
কলকাতার শিয়ালদা, কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়া, নিউমার্কেট এলাকায় ঘুরে, চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কলকাতা শহরে প্রায় ১৮ হাজার হাতে টানা রিকশা চালক আছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগেরই নিজস্ব রিকশা নেই। এরা ‘সর্দারের কাছ থেকে রিকশা নিয়ে চালান।
কারা এই রিকশা চালকদের ‘সর্দার’? জানা গেল এই ‘সর্দার’ মালিকের কাছ থেকে রিকশা ভাড়া করেন। তার পর তিনি চালকদের সেই রিকশা চালাতে দেন। এর বিনিময়ে ‘সর্দার’ একটি ভাড়া নেন। তাকেও আবার মালিককে রিকশা পিছু প্রতিদিনের ভাড়া দিতে হয়। সব বাদ দিয়ে দৈনিক গড়ে চালকদের হাতে থাকে ১০০-১৫০ রুপি।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলে এই টানা রিকশার ব্যবসার কিছুটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু ‘সর্দার’ হবার যোগ্যতা কি? জানা গেল ‘ডেরা’ না থাকলে সর্দার হওয়া যাবে না। সন্ধান করে কলকাতার কাঁকুড়গাছি এই রকমই এক ‘ডেরা’-তে হাজির হলাম।
প্রাথমিক ধারণায় মনে হয়েছিল ‘ডেরা’ মানে রিকশা চালকদের থাকার জায়গা। কারণ এই চালকদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতের অন্যান্য প্রদেশের। কিন্তু ডেরাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ‘ডেড়া’ একদিকে যেমন চালকদের রাত কাটানোর জায়গা অন্যদিকে রিকশার ‘গ্যারেজ’।
এ রকম ডেরার মালিক আনোয়ার হোসেন জানালেন অনেক চালককেই ডেরায় জায়গা দেওয়া যায় না। তাই তারা অনেকেই শহরের ফুটপাতে রাত কাটান।
ডেরা গুলির চেহারা খানিকটা ‘কমিউন’-এর মতো। এক সঙ্গে খাওয়া, একসঙ্গে থাকা, একে অপরের সুখ- দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। যে চালক যেদিন কাজে বের হন না তার দায়িত্ব পরে বাজার এবং রান্না করার।
আলাপ হল লাল বাবু ঠাকুরের সঙ্গে। ইনি রিকশা চালক নন, রিকশার মিস্ত্রী। লাল বাবু ঠাকুর জানালেন তাকেও নতুন পেশার সন্ধান করতে হবে।
কারণ কলকাতা শহর থেকে টানা রিকশা উঠে গেলে তার হাতে কাজ থাকবে না। কলকাতার এক ডেরাএর মালিক জানালেন হয়ত আগামী দিনে খালি হয়ে যাবে ‘ডেরা’। যেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই সেখানে বিরাজ করবে শূন্যতা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার মনে করছেন হাতে টানা রিকশা অমানবিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ কলকাতাবাসীরও তাই মত। আর সেই মতামতকেই প্রধান্য দিয়েই আর কিছুদিনের মধ্যে বাতিল হয়ে যাবে টুং টাং শব্দ করে এ রিকশা।
কিন্তু চিন্তিত রিকশার চালকরা। তারা জানেন তাদের যন্ত্রচালিত রিকশা দেওয়া হবে। এই নিয়ে রিকশা চালক সংগঠনের সঙ্গে কথাও বলেছে সরকার। কিন্তু তাদের অনেকের ভায় তারা কি আদৌ পারবেন সেই সব যন্ত্রচালিত রিকশা চালাতে। নাকি তাদেরও এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্য কোন পেশার খোঁজে। এর উত্তর দিতে পারবে একমাত্র ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশ সময়: ০৩০৫ ঘণ্টা, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৫