ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

ধুলার আস্তরে জমা অভিমানে কবি নজরুলের জন্মভিটা

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪১ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
ধুলার আস্তরে জমা অভিমানে কবি নজরুলের জন্মভিটা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চুরুলিয়া থেকে ফিরে: মেঠোপথ ধরে ঝক্কির জার্নি শেষে দাঁড়ালাম ঠিক কবির বাড়ির দরজায় গিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের ‍আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বাড়ি।

বাইরে থেকে বেশ চাকচিক্য। হলুদরঙা বাড়িটির গেটে সাদা আলপনা। উপরে আঁকা আগুনঝরা অগ্নিবীণা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জন্মভিটা- এটি জানান দিতে যেন এই প্রতীকী রূপই যথেষ্ট!

তৎকালীন সময়ের  বিখ্যাত কবি, শিক্ষক ও কাজী নজরুলের অন্যতম অনুপ্রেরণা কুমুদ রঞ্জন মল্লিক লিখেছেন ‘ছোট সুন্দর চনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল। ’

সেই লাজুক দুখুমিয়ার বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে অনুভূত হচ্ছিলো অন্যরকম। এই আঙিনায় মুখর পদচারণায় বেড়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার বাবা কাজী ফকির আহমদ ও মা জাহেদা খাতুন। এই বাড়ি থেকেই কবি যোগ দিয়েছিলেন লোটো গানের দলে। সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এ বাড়িতেই এসেছিলেন তিনি। এই বাড়িতে বসেই কবি লিখেছিলেন একের পর এক কবিতা, গান।

কবির মৃত্যুর তিনযুগেরও বেশি সময় পর কী অবস্থায় রয়েছে তার সেই জন্মভিটা? 

এই বাড়িতেই গড়ে উঠেছে নজরুল একাডেমি। দোতলা বাড়ির নীচতলায় দুটি ঘর। এর মধ্যে একটি অফিস ঘর। যেখানে বসে কাজী নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে মেলার নিমন্ত্রণপত্রে আমন্ত্রিতদের নাম লিখে চলছেন এক তরুণ। তার চেয়ারের পেছনের দেয়ালজুড়ে চক্ষু পরীক্ষা শিবিরের ব্যানার। অন্য ঘরে একটি বড় টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার পাতা।

ছিমছাম পরিবেশ। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রিয় কবির জন্মভিটে হিসেবে যে রকম আশা করা গিয়েছিলো তেমনটা নয়। ঘরের কোণে জমে থাকা ঝুল আর জানলার উপরে জমে থাকা ধুলো সেই অভিমানের কথাই বলছে। দোতলায় রয়েছে প্রচুর সংখ্যক বই। তার উপরেও ধুলোর আস্তরণ। দেখে বোঝা যায় বিশেষ কেউ আসেন না এসব বই পড়তে।   বাইরে থেকে রংচঙে বাড়িটির ভিতরে দশা জরা-জীর্ণ।

নিমন্ত্রণপত্রে নাম লিখতে ব্যস্ত থাকা যুবকটি জানালেন, সংগঠনের সম্পাদক কাজী মাজাহার হোসেন। ইনি নজরুল ইসলামের ছোট ভাইয়ের সন্তান। সম্পর্কে নজরুল ইসলামের পৌত্র। নজরুল একাডেমির মধ্যে চাকচিক্যের বালাই নেই। বরং বলা যায় চেহারার মিল রয়েছে পাড়ার ক্লাবের সঙ্গে। সম্পাদকের জন্য অপেক্ষা করার মাঝেই গ্রামের একজন এলেন চক্ষু পরীক্ষা শিবিরের খবর নিতে। এই বাড়ির পিছনেই থাকেন কাজী পরিবারের কিছু সদস্য।

১৯৫৮ সালে মাত্র ছয়জন কৃষক নিয়ে তৈরি হয় এই নজরুল একাডেমি। একাডেমির সম্পাদক কাজী মাজাহার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে মেলার আয়োজন করে নজরুল একাডেমি। এছাড়া প্রকাশ করা হয় ‘প্রমীলা-নজরুল’ নামের একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা। ১৯৮০ সাল থেকে চালু করা হয়েছে ‘নজরুল পুরস্কার’।

তিনি আরও জানান ‘অগ্নিবীণা –কে হিন্দিতে অনুবাদ করার কাজ হয়েছে নজরুল একাডেমির উদ্যোগেই। এ কাজ ছাড়াও হয় নিয়মিত চক্ষুপরীক্ষা শিবির।

কিন্তু দোতলায় এত মূল্যবান বই কেউ ব্যবহার করেন না কেন? কাজী মাজাহার হোসেন জানান, ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ নেই। কিছু মানুষ আসেন বই লেখার তাগিদে, সেই সংখ্যাও খুব কম।

তিনি মনে করিয়ে দিলেন, নজরুল একাডেমির পক্ষ থেকে কাজী নজরুলের উপর লেখা বিভিন্ন বইয়ের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যগুলি সংশোধন করা হয়।

সরকারি সাহায্যের কথা উঠতেই ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারলেন না বৃদ্ধ এ মানুষটি। ২০১১ সালে শেষ মেলার জন্য অনুদান পাওয়া গিয়েছিলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে। তার পর থেকে ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালে একাধিকার চিঠি দিয়েও মেলার জন্য কোনো অনুদান পাওয়া যায়নি। আলাদা করে নজরুল একাডেমির জন্য কোনোদিন কোনো অনুদান আসেনি পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সরকারের কাছ থেকে।

কোনো সাহায্য এসেছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে? এ প্রশ্নের উত্তরে  কাজী মাজাহার ইসলাম জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মভিটায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো সাহায্য আসেনি।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে  কলকাতায় তৈরি হয়েছে ‘নজরুল তীর্থ’, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যথেষ্ট বড় করে পালন করে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। তবে কবির জন্মভিটায় গড়ে ওঠা নজরুল একাডেমি সরকারের নজরেরই বাইরে কেন?

প্রশ্ন করা হলে সোজা কথার মানুষ কাজী মাজাহার ইসলাম জানান, তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবির বাস্তুভিটার উপর গড়ে তোলা নজরুল একাডেমি তিনি অন্য কারো হাতে ছেড়ে দেবেন না। তার আবেদন সরকারের কিছু ইচ্ছা করার থাকলে তার জন্মভিটেয় করুক।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এখান থেকে ঘুরে গেছেন বলে জানালেন তিনি। এসেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন  অটল বিহারী বাজপেয়ীও। কিন্তু সাহায্য আসেনি।

চোয়াল শক্ত করে কাজী মাজাহার জানান, আর কারও কাছে সাহায্য চাইতে যাবেন না।

বেরিয়ে এলাম কবির বাড়ি থেকে। শহর থেকে অনেক দূরে, তাই কী এত অবহেলা! সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ভারতের প্রথম সারির হিন্দি ভাষার কবিদের মধ্যে একজন আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিয়মিত কবিতা লেখেন। এরা সবাই এসেছে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভিটায়।

আশা করা যায় তারা আগামী দিনে সচেষ্ট হবেন কবির জন্মভিটাকে আরও সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলতে। আগামী প্রজন্ম বিদ্রোহী কবি নজরুল সম্পর্কে জানানোর দায় প্রতিটি মানুষের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা।

নজরুল একাডেমির পাশেই রয়েছে নজরুল মিউজিয়াম। তার পাশে নজরুল পাঠাগার। আগামী প্রতিবেদনে থাকবে সেই সবকিছুর অতীত-বর্তমান পরিস্থিতির কথা।  

বাংলাদেশ সময়: ০০৪০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
এএ

** নজরুলতীর্থ চুরুলিয়ার পথে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।