কলকাতা: টানা ৩৪ বছর ধারাবাহিক নির্বাচিত সরকার পরিচালনার পর ২০১১ সালে ঘটলো বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয়। এর কারণ হিসেবে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বিরোধীদের পরিবর্তনের স্লোগানে মানুষের আগ্রহকে আমরা বুঝতে পারিনি।
বিমান বসু কারণ না বললেও শুক্রবার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটসহ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে বামফ্রন্টের নজিরবিহীন এ ভরাডুবির পেছনে কিছু কারণের কথা জানা যায়।
৩৪ বছরের শাসনের মধ্যে গত তিনটি বছর ছিল বামফ্রন্টের জন্য চ্যালেঞ্জের। গত বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের স্লোগান ছিল ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি। শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। ’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক শিল্পায়নের লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সেনাপতি করে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিল বামফ্রন্ট। সে সময় সংবাদ মাধ্যমের ব্রান্ড বুদ্ধের তকমা পাওয়া মুখ্যমন্ত্রী ২৩৫টি আসনে জয়লাভ করেছিল বামফ্রন্ট। বিরোধীরা যখন সরকারের বিরোধিতা করতেন সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী তখন মনে করিয়ে দিতেন, আমরা ২৩৫, ওরা কত? এই ঔদ্ধত্বই হয়তো বামফ্রন্টের পতনের শুরু। সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা বামকর্মীরাও মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। আর এজন্যই মানুষের কাছে থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়।
টাটা শিল্পগোষ্ঠী যখন পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে চাইলো, তখন এমন একটি স্থান বাছাই করা হলো, যে বিধানসভা আসনটি তূণমূলের দখলে ছিল। স্বভাবতই রাজ্য-সরকারের বিরোধিতা করার একটি নতুন ইস্যু হারিয়ে-যাওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের পালে হাওয়া এনে দিল। সিঙ্গুরে দীর্ঘদিন অবস্থান করে মমতা ব্যানার্জি একটা পর্যায়ে জমি হারানো কৃষকদের পক্ষে আন্দোলন করে টাটা ও রাজ্য সরকারকে বাধ্য করলেন এই কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করতে।
ঠিক একই ঘটনা ঘটলো পূর্ব মেদেনীপুর জেলার তৎকালীন বামপন্থীদের ঘাঁটি নন্দীগ্রামেও। এখানেও কেমিক্যাল কারখানা করার জন্য জমি অধিগ্রহণ করলো রাজ্য সরকার। কৃষকের বন্ধু বলে দাবিদার বামফ্রন্ট সরকার কৃষকদের জমি কেড়ে নিচ্ছে--এই স্লোগানকে সামনে রেখে ওখানেও আন্দোলন শুরু করলেন মমতা। এবার আর মমতা একা নন, তার সঙ্গে যোগ দিলেন রাজ্যের সবক’টি বিরোধীদল। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরাও বসে থাকলেন না, তারাও হাঁটলেন মমতার সঙ্গে।
‘মা, মাটি ও মানুষ’--এ স্লোগান সামনে রেখে মমতা ব্যানার্জি এই দুই অঞ্চলের সংখ্যালঘু মানুষের কাছে নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। একদা যে সংখ্যালঘু মুসলিমরা বিজেপির সঙ্গে জোট ও সখ্যের কারণে মমতাকে অচ্ছুৎ করে রেখেছিলেন, সেই সংখ্যালঘু মুসলিমরাই বামপন্থীদের দীর্ঘদিনের ভোটব্যাংক থেকে আশ্রয় নিলেন তৃণমূলের পতাকাতলে। এরই মধ্যে ভারত সরকারের সাচার কমিটির প্রতিবেদনে প্রকাশ পেল, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা করুণ অবস্থায় রয়েছে। এই কারণটিও মমতার পক্ষে গেল। এরই মধ্যে ২০০৯ সালে লোকসভার নির্বাচন, নন্দীগ্রামসহ কয়েকটি বিধানসভার উপনির্বাচন, পৌরসভা ও পঞ্চায়েতভোটে তৃণমূল একক শক্তিতে বামফ্রন্টকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। একের পর এক পরাজয় দীর্ঘদিনের বাম শাসনের পরিবর্তনের অভিমুখকে চিহ্নিত করলো।
রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার রেল দপ্তরের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাম সরকারকে বাদ দিয়েই একটি বিকল্প ধারা তৈরি করলেন। একের পর এক নতুন ট্রেন ও রেললাইন স্থাপন এবং কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে মমতা তার শিল্পবিরোধী তকমাকে মুছে ফেলতে সক্ষম হলেন রাজ্যের ব্যবসায়ী মহলে। যার ফলে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও তার প্রতি আস্থা জানাতে শুরু করলো।
পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধির জন্য মমতাকে দায়ী করলো সিপিএম। যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের দাবিকে সামনে নিয়ে ও জঙ্গলমহলের অনুন্নয়নের কথা বলে ওই অঞ্চলের গরীব আদিবাসীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বামদুর্গে ধ্বস নামাতে সক্ষম হলেন মমতা।
একইভাবে পাহাড়ে গিয়ে রাজ্যভাগের বিরুদ্ধে গিয়েও মমতা রাজ্যভাগের দাবিদার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করলেন। তাদের বিধানসভা নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামাতে সক্ষম হলেন।
আটপৌঢ়ে চেহারার হাওয়াই চটি ও সাদা শাড়িপরা মধ্যবয়সী এই নারী আপামর জনসাধারণের কাছে হয়ে উঠলেন আপনজন। উল্টোদিকে একদা ‘ব্রান্ড বুদ্ধ’ ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছিলেন ‘ব্যানড বুদ্ধ’তে। তবে সেটা বুঝতে পারছিলেন না বামফ্রন্ট নেতারা। তাই নির্বাচনের ফল বোরোনোর প্রথম দু’ঘণ্টাতেও তাদের মধ্যে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুর--- অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই, তারা স্বীকার করলেন: ‘বুঝতে আমাদের ভুল হয়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১১