রাজভবন (কলকাতা) থেকে: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। সারাজীবন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতি করে তিনি অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
শুক্রবার দুপুরে কলকাতার রাজভবনে রাজ্যপাল এমকে নারায়ণন তাকে শপথবাক্য পাঠ করান।
বেলা ১টা ০১ মিনিটে মিলিটারি ব্যান্ডে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়।
রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর পাল ইংরেজিতে মমতা ব্যানার্জিকে মঞ্চে আসার আমন্ত্রণ জানান এবং রাজ্যপালকে শপথ পড়ানোর অনুরোধ জানান।
মুখ্যমন্ত্রীর শপথবাক্য পাঠকালে তিনি বলেন, ‘আমি মমতা বন্দোপাধ্যায়, ঈশ্বরের নামে শপথ করিতেছি যে, বিধি দ্বারা স্থাপিত ভারতের সংবিধানের প্রতি আমি অকপট শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা পোষণ করিব। আমি ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষা করিয়া চলিব। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রূপে আমার কর্তব্যসমূহ শ্রদ্ধাপূর্বক এবং সিদ্ধান্তকরণে নির্বাহ করিব, ভয় বা পক্ষপাত, অনুরাগ বা দ্বেষ রহিত হইয়া সর্বপ্রকার জনগণের প্রতি এই সংবিধান ও বিধি অনুসারে ন্যায়াচরণ করিব। ’
এছাড়া দেশ ও রাজ্যের তথ্য সংরক্ষণবিষয়ক অপর একটি শপথ বাক্যও তিনি পাঠ করেন।
দ্বিতীয় শপথবাক্যে তিনি বলেন, ‘আমার নিকট বিবেচনার জন্য যে বিষয় আনিত হইবে অথবা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যে বিষয়ে আমি অবগত হইবো, তাহা আমার কর্তব্যসমূহের যথোচিত নির্বাহের জন্য আবশ্যক না হইলে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের নিকট সঞ্চারিত বা ব্যক্ত করিব না। ’
এরপর তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের স্বাক্ষর করেন।
মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া ৩৭ মন্ত্রী এদিন পৃথকভাবে শপথ নেন।
বেলা বারোটার মধ্যেই শপথগ্রহণস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ৩২০০ আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হলেও রাজভবন প্রাঙ্গণের ওই অনুষ্ঠানস্থলে হাজার চারেক মানুষ উপস্থিত হন।
সদ্যসাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ রাজ্য ও রাজ্যের বাইরের বিশিষ্ট অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের বাইরেও মমতার আগ্রহে দুইজন করে বস্তিবাসী, রিকশাচালক, যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন এনজিও’র প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
বেলা আড়াইটার সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনের পর জাতীয় সঙ্গীতের যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের পর স্থানীয় সময় বেলা ২টা ৩৪ মিনিটে শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়।
এরপর রাজভবনের দক্ষিণ লনে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য চা চক্রের আয়োজন করেন রাজ্যপাল।
বেলা পৌনে তিনটার দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা একান্তে বৈঠক করেন রাজ্যপাল এমকে নারায়ণনের সঙ্গে। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তারা কথা বলেন।
রাজভবন থেকে বেরিয়ে মমতা ব্যানার্জি যান রাইটার্স বিল্ডিংয়ে (সচিবালায়)। সন্ধ্যার পর নয়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসবেন তিনি।
৩৭ মন্ত্রীর শপথ:
মমতার মন্ত্রিসভার ৩৭ সদস্যের মধ্যে ৩৩ জন পূর্ণমন্ত্রী। এদের মধ্যে ২ জন কংগ্রেসের। প্রতিমন্ত্রী চারজন।
মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথবাক্যের শুরুতে যিনি যে ধর্মের অনুসারী সে অনুসারে কেউ আল্লাহ, কেউ ঈশ্বর বা বুদ্ধের নামে শপথ বাক্য পাঠ শুরু করেন।
শপথ নেওয়া পূর্ণমন্ত্রীরা হলেন- সুব্রত বকশী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ড. অমিত মিত্র, মনীশ গুপ্ত, সুব্রত মুখার্জি, আব্দুল করিম চৌধুরী, সাধন পান্ডে, উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, জাভেদ আহমেদ খান, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সাবিত্রী মিত্র, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শান্তিরাম মাহাতো, হায়দার আলী সফি, মলয় ঘটক, পূর্ণেন্দু বসু, ব্রাত্য বসু, রাজপাল সিং, হিতেন বর্মন, গৌতম দেব, নূরে আলম চৌধুরী, শংকর চক্রবর্তী, রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, ডা. সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার, উজ্জ্বল বিশ্বাস, শ্যামাপদ মুখার্জি, ফিরহাদ হাকিম, ড. সুকুমার হাঁসদা, সৌমেন মহাপাত্র, অরূপ রায়, চন্দ্রনাথ সিনহা, মানস রঞ্জন ভূঁইঞা, আবু হেনা।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর, মদন মিত্র, সুব্রত সাহা, শ্যামল ম-ল। এরা চারজনই তৃণমূল কংগ্রেসের এমএলএ।
পূর্ণ মন্ত্রীদের মধ্যে মানস রঞ্জন ভূঁইয়া ও আবু হেনা কংগ্রেসের।
৬টি ভাষায় শপথবাক্য তৈরি করা হয়। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, সাঁওতালি ও নেপালি ভাষায় শপথ বাক্য প্রস্তুত করে রাখে রাজ্যপালের দপ্তর।
নেপালি ভাষা ছাড়া মন্ত্রীরা তাদের ভাষা হিসেবে ৫টি ভাষায় শপথ নেন।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর আসনের এমএলএ আব্দুল করিম চৌধুরী উর্দুতে শপথ বাক্য পাঠ করেন, কলকাতার বালিগঞ্জের জাভেদ আহমেদ খান ইংরেজিতে, কলকাতার বন্দর আসনের ফিরহাদ হাকিম ইংরেজিতে ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামের ড. সুকুমার হাঁসদা সাঁওতালি ভাষায় শপথ নেন।
অন্যদিকে রাজ্যের সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তা হায়দার আলি সফি ও রাজপাল সিং অবাঙালি হয়েও বাংলায় শপথ বাক্য পাঠ করেন।
জঙ্গলমহলের বলরামপুর আসনের শান্তিরাম মাহাতো সাঁওতাল ভাষী হলেও তিনি বাংলায় শপথ নেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন:
মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ শেষ হলে আড়াইটায় ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়’ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হয়।
শিল্পী শমীক পাল রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। এটি পরিবেশনের জন্য মূল মঞ্চের পাশে ছোট পৃথক মঞ্চ তৈরি হয়, যেখানে টেবিলের ওপর শমীক পাল হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
ফুলশোভিত শৈল্পিক মঞ্চ:
শপথ অনুষ্ঠানের জন্য রাজভবন প্রাঙ্গনে সবুজ ও সাদা কাপড় দিয়ে তৈরি হয় বিশাল প্যান্ডেল। অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জাতেও থাকে শৈল্পিক ছোঁয়া।
মূলমঞ্চে ওঠার পথে বিশাল তামার পাত্রে ভরা থাকে রাশি রাশি জুঁইফুল। তার সামনে মঙ্গলঘট। মূলমঞ্চের সামনে ফুলের সজ্জা। সিঁড়ি ফুলে মোড়ানো।
সবুজ-সাদা কাপড়ের মূল মঞ্চের দেওয়ালও সাজানো হয় সাদা শোলার (ককসিট) কদমফুল দিয়ে।
অতিথিদের চেয়ারগুলো সাদা কাপড়ের কভার দিয়ে ঢাকা ছিল।
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা:
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজভবনসহ আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। রাজভবন, মহাকরণের আশপাশে মোতায়েন থাকে ‘কুইক রেসপন্স টিম’, অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কমান্ডোবাহিনী।
রাজভবনের ভেতরে ও আশপাশের রাস্তায় পুলিশবাহিনীর পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য রাখা হয় ।
রাজভবনে প্রায় ১ হাজার নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশের পাশাপাশি নিরাপত্তা রক্ষায় বিশেষ বাহিনী যেমন, ইনসাস, র্যাফ ও স্যাফ দায়িত্ব পালন করে।
রাজভবনের বাইরে তৈরি করা হয় ব্যাঙ্কার।
শহীদ মিনার ও মহাকরণের আশপাশে শুক্রবার সকাল থেকে আরও প্রায় এক হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামীম শুক্রবার বাংলানিউজকে জানান, শপথ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় পুলিশের ৫ জন উপ-কমিশনার (ডিসি) দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বলেন, ‘রাজভবনের বাইরে দু’জন ডিসি ও ভেতরে তিনজন ডিসি দায়িত্বে থাকেন। ’
এছাড়া রাজভবনের প্রতিটি গেটে কলকাতা পুলিশের একজন করে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে পুলিশ মোতায়েন থাকে।
এদিকে ব্যস্ততম মেট্রো চ্যানেল, ডোরিনা ক্রসিং, শহীদ মিনার ময়দানসহ মধ্য কলকাতার ডালহৌসি ও ধর্মতলার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় পুলিশের নজরদারি এদিন সকাল থেকেই বাড়ানো হয়।
ধর্মতলা এলাকার কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদেও নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেয়।
শপথ গ্রহণ কলকাতায় হাজারো মানুষ:
শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের বাইরেও যারা আমন্ত্রণ পাননি বা আমন্ত্রিত হবার ‘যোগ্য নন’ তারাও বাদ যাবেন কেন। এদের অনেকই খবর পান ধর্মতলার সংলগ্ন এলাকায় বড় পর্দা বসানো হয়েছে। তাই রাত জেগে অনেকই ‘রেলমন্ত্রী’ মমতার ট্রেনে চেপে আসেন কলকাতায়। উত্তরের জেলা থেকে শুরু করে দক্ষিণ পশ্চিমের জঙ্গলমহল বাদ যাননি কোনও এলাকার মানুষ।
মমতা ব্যানার্জির যাওয়া-আসার পথে ভিড় করেন হাজারো মানুষ। লেনিন সরনী, জহরলাল নেহেরু রোড, আউটট্রমঘাট, লালদীঘি, ডালহৌসী চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আগন্তুকরা।
বড় পর্দা বসানোর কারণে শহীদ মিনার চত্তরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। হকাররা সকাল থেকে জায়গা দখল করে পসরা সাজিয়ে বসে। বিক্রির তালিকায় মমতা ছাড়াও হরেকরকম পণ্য রয়েছে। তেলেভাজা থেকে শুরু করে চালু হয় অস্থায়ী ভাতের হোটেল।
কলকাতাবাসীর দুপুর ১২টা পর থেকেই চোখ রাখে টিভির পর্দায়। কলকাতার প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেলই সরাসরি এই অনুষ্ঠান দেখায়। সরকারি ছুটি না হলেও যেখানেই থাকুন না কেন মাহেন্দ্রক্ষণটি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হারাতে চাননি কেউ।
এদিকে, আমন্ত্রণ যারা পেয়েছেন তাদের কিছু নির্দেশনা মেনে যেতে হয় রাজভবনে।
রাজ্যসরকারের পক্ষে মুখ্যসচিব সমর ঘোষ আমন্ত্রণপত্র ১৬ মে তারিখে ইস্যু করেছেন। এই পত্রে লেখা আছে ‘নতুন মন্ত্রীসভার শপথ করাবেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল। রাজভবন প্রাঙ্গণে বেলা ১টা ০১ মিনিটে এই শপথ অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিত কাম্য। ’
কালীঘাট থেকে রাজভবন: মানুষের ভালবাসার সিক্ত
মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার উদ্দেশ্যে শুক্রবার বেলা সাড়ে বারোটায় কালীঘাটের বাড়ি থেকে বের হন মমতা। বাড়ির বাইরে এলেই অপেক্ষমান কর্মী-সমর্থকরা বিপুল হর্ষধ্বনি দিয়ে মমতাকে স্বাগত জানান। মমতা ব্যানার্জি মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সকলে ভালো থাকবেন। আপনাদের জন্যই এই সুযোগ। ’
এই মুহূর্তে তার অনেক কাজ, আগামী কয়েকদিন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না বলেও তিনি জানান।
বাড়ির সামনে থেকেই তিনি তার নিজের কালো রঙের স্যান্ত্রো গাড়িতে ওঠে রাজভবনের দিকে যাত্রা করেন। মূখ্যমন্ত্রীর জন্য নতুন কেনা বুলেট প্রুফ গাড়িতে তিনি ওঠেননি।
গাড়িটি সমর্থকদের ফুলের পাপড়িতে ঢেকে যায়।
৫১ জন ঢাকী ঢোলের বাদ্য দিয়ে মমতাকে বাড়ি থেকে বিদায় জানান।
কালীঘাট থেকে বেরিয়ে গোপালনগর মোড় দিয়ে ভবানীভবন হয়ে জাতীয় গ্রন্থাগারের পাশ দিয়ে ভবানীপুর ডিএল শাহ রোড হয়ে মমতার গাড়ির বহর এগিয়ে চলে রাজভবনের দিকে। পথে বাঙুর হাসপাতাল, ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে দিয়ে, রেড রোড ধরে ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে তিনি পৌঁছে যান রাজভবনের মূল ফটকে।
পথে রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য মানুষ তাকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। অনেকের হাতে ছিল দলীয় পতাকা। অনেক মহিলা শঙ্খ দিয়ে শাঁখ বাজান। পথের কয়েকটি স্থানে রাস্তার ফুটপাত থেকে মানুষ মূল সড়কে নেমে আসায় কিছুটা যানজটেরও সৃষ্টি হয়। মানুষের উৎসাহে তার গাড়িবহর কিছু সময়ের জন্য থামাতেও হয়।
বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে তিনি রাজভবনের পশ্চিম অংশের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছান। সেখানেও কিছুটা দূরে পুলিশের নিরাপত্তারক্ষা ব্যুহের বাইরে জনজোয়ার। তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন মমতা ব্যানার্জি।
মূল ফটকের সামনে গাড়ি থেকে নেমে তিনি হেঁটে রাজভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন।
কংগ্রেস নেত্রী থেকে মূখ্যমন্ত্রী: চার দশকের রাজনৈতিক জীবন
পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করে শুরু করে সর্বশেষ মূখ্যমন্ত্রী হলেও অনেক আগেই সাদা শাড়ির মমতা সর্বভারতীয় একটি ইমেজ তৈরি করে নিয়েছেন। পরনে সাধারণ সূতির শাড়ি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, পায়ে রাবারের হাওয়াই চটি। এ ব্যাগটির নাম তিনি দিয়েছেন ‘জঙ্গলমহল’।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনি বরাবরই লোকসভা (জাতীয় সংসদ) নির্বাচন করেছেন। ১৯৮৯ সালে একবার মাত্র পরাজয় ছাড়া, ১৯৮০ সাল থেকে তার পরাজয়ের রেকর্ড নেই। এবার বিধানসভায় তার দলের জয়ের পর অবশ্য আগামী ছয়মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিধানসভায় নির্বাচনে দাঁড়াতে যাচ্ছেন তিনি।
১৯৫৫ সালে ৫ জানুয়ারি মমতা জন্মগ্রহণ করেন। কালীঘাটের ৩০/বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে তার জন্ম। বাবা প্রমীলেশ্বর ব্যানার্জি মারা যান ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। মা গায়েত্রী দেবী ও দুই ভাইকে নিয়েই তিনি এখন মূখ্যমন্ত্রী হলেন।
৩০/বি হরিশ চ্যাটার্জি রোডের বাড়ি ছেড়ে মা কে নিয়ে ক’দিনের জন্য তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, তার এমপি পরিচয় ব্যবহার করে দু’ভাই বিভিন্নভাবে অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছিলেন।
সত্তুরের দশকের শুরুতে যোগমায়া দেবী কলেজে পড়ার সময়ই মমতা কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র পরিষদে’র সঙ্গে যুক্ত হন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যোগমায়া কলেজ থেকে পাসকোর্সে বিএ পাসের পর তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুলের শিক্ষকতা করার উদ্দেশ্যে তিনি ভবানীপুর শ্রীশিক্ষায়তন থেকে বিএড পাস করেন। আবার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রিও নেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি একটি স্কুলেও শিক্ষকতা শুরু করেন। ভাইদের ঠিকাদারি ব্যবসা করতে বলেন।
সত্তুরের দশকের মাঝামাঝিতে সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও প্রিয়রঞ্জন দাশ মুন্সীর নেতৃত্বে মমতার ছাত্র রাজনীতির শুরু।
১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রচারে কলকাতায় সভা করতে আসা নবনির্মাণ আন্দোলনের নেতা সমাজবাদী জয়প্রকাশ নারায়ণকে প্রতিহত করে মমতা প্রথম আলোচনায় আসেন। সেদিন জয়প্রকাশের গাড়ির বনেটে উঠে প্রতিবাদ করেছিলেন।
এরপর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কলকাতা সফরে গাড়িতে কালো পতাকা লাগিয়ে আরেকবার আলোচনায় আসেন মমতা।
এভাবে প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তাকে ‘পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেসে’র সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্বে পালন করেন।
সেবছর লোকসভা (জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে তাকে কংগ্রেস থেকে প্রথমবারের মতো প্রার্থী করা হয়।
যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সিপিআইএমের জাঁদরেল নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী মমতা। সোমনাথ হলেন ধরাশায়ী।
ভারতের অন্যতম অল্পবয়সী সংসদ সদস্য মমতার রাজনৈতিক কর্মস্পৃহায় খুশি হয়ে রাজিব গান্ধী তাকে ‘সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন।
১৯৯০ সালের ১৬ আগস্ট তার বাড়ির কাছে হাজরা মোড়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের লাঠির আঘাতে তার মাথা ফেটে গেলে ২৪টি সেলাই দিতে হয়।
১৯৯৩ সালের ৭ জানুয়ারি নদীয়ার এক ধর্ষিতা মূক-বধির নারীর শ্লীলতাহানির বিচার চাইতে মহাকরণে গেলে পুলিশ তাকে পাঁজাকোলা করে বাইরে বের করে দেয়। সেদিন মমতা বলেছিলেন, ‘সম্মান নিয়েই একদিন মহাকরণে ফিরবো। ’
১৯৯২ সালের ২২ নভেম্বর কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন।
রাজ্যে সিপিআইএমকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্য ও কৌশল নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার বিরোধ দেখা দিতে শুরু করে নব্বই দশকের শুরুর দিকে।
মমতা চেয়েছিলেন, তাকে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি করা হোক। কিন্তু সৌমেন মিত্রের মতো প্রভাবশালী নেতাকে বাদ দিয়ে তা করা যায়নি। মমতা সেসময় থেকে মমতা বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস নেতৃত্বর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন এবং দল ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৯ আগস্ট মমতা গঠন করেন ‘তৃণমূল কংগ্রেস। ’ নভেম্বর মাসে তাকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়।
দল গঠনের পর মমতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করেন। এতে ভালো ফল পাননি।
দলের তার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন সময়ে দল ছেড়ে যান, আবার ফিরেও আসেন।
রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই তিনি রাজ্যে আন্দোলনে সফল হন।
ব্যক্তিগত জীবনে মমতা কবিতা লেখেন, ছবি আঁকেন। গানও করেন।
অবিরাম গতিতে রাজনীতির পথে হেঁটে চলা এই বাঙালি নারী ‘বিবাহ করার সময়’ পাননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১১