ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

কলকাতা বিরিয়ানির এক টুকরো ইতিহাস

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২১
কলকাতা বিরিয়ানির এক টুকরো ইতিহাস কলকাতা বিরিয়ানির এক টুকরো ইতিহাস। ছবি: বাংলানিউজ

কলকাতা: মোঘল আমলে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার ছিল বিরিয়ানি। তবে বিরিয়ানির জন্ম কীভাবে বা মেন্যুর স্রষ্টা কে, তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে।

 

কারণ বৈদিক যুগেও ঘি, সুগন্ধি মশলা, চাল ও মহিষের মাংস মিশ্রিত খাবারের কথা বর্ণিত আছে। তখন এ খাবার খাওয়া হতো ক্ষত্রিয় বংশে। এছাড়া যে নারী এক যোদ্ধার সমান পুত্র-সন্তানের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, তাদের নিয়মিত পরিবেশন করা হতো এ খাবার। আবার অনেকের মতে মোঘল আমলে নবাব, সম্রাটদের শিকারের সময় বা রণক্ষেত্রে সহজপাচ্যে শক্তিযুক্ত যে খাবার পরিবেশনা করা হতো, তাই বিরিয়ানি। তবে জন্মসময় নিয়ে নানামত থাকলেও ‘বিরিয়ানি’ নাম ও তার প্রসার এবং পরিচিতি কিন্তু মোঘল আমলেই। কারণ বিরিয়ানি হলো উর্দু শব্দ। যা ফরাসি ভাষা থেকে এসেছে।

এদিকে বিরিয়ানি জন্ম নিয়ে বিতর্ক যাই থাক না কেনো, কলকতার এক সমীক্ষা বলছে বেশির ভাগ বাঙালির  খাবারের মধ্যে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বিরিয়ানি। আর তা দিল্লি, লখনৌ হয়ে প্রবেশ করেছিল কলকাতায়। বছর কুড়ি আগেও এ শহরে বিরিয়ানি এত সহজলভ্য ছিল না। একমাত্র মিলত আভিজাত শ্রেণির কোনো অনুষ্ঠানে। আর এখনতো গ্রাম, শহরতলি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার অলিতে গলিতে। সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাল কাপড়ে মোড়া হাঁড়ি ভর্তি বিরিয়ানি। নতুন চাকরি পাওয়া থেকে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট, বিয়ে বাড়ি কিংবা জন্মদিনের পার্টি, নতুন প্রেমপ্রস্তাব অথবা প্রথম ডেটিং, শিশু থেকে প্রৌঢ় শহরের সবার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বিরিয়ানি।  

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে বিরিয়ানির রং এবং স্বাদ। সব রাজ্যের বিরিয়ানির স্বাদ এবং রং এক নয়। কলকাতার বিরিয়ানি বলতে যা বোঝায়, তা কিন্তু লখনৌর আদলে। অর্থাৎ কলকাতায় যে বিরিয়ানি মেলে তার সঙ্গে স্বাদ এবং রঙের মিল আছে লখনৌর সঙ্গে। তবে ভারতে কলকাতা বাদে বিরিয়ানিতে আর কোথাও আলুর ব্যবহার হয় না।

কলকাতায় মূলত তিন ধরনের বিরিয়ানি চল বেশি। চিকেন বা মাটন বিরিয়ানি, ডিম বিরিয়ানি এবং আলু বিরিয়ানি। তবে জায়গা বিশেষে মেলে বিফ বিরিয়ানি। মাত্র এক জায়গায় মেলে মহিষের মাংসের বিরিয়ানি। এছাড়া গাজর, বিনসের মত সবজি দিয়ে মেলে নিরামিষ বিরিয়ানি। কলকাতায় এত রকমের বিরিয়ানি মিললেও তিনটি বিষয় একবারে কমন। এক, ভাতের রং হতে হবে হালকা হলদেটে। দুই, বিরিয়ানির প্লেটে থাকতে হবে এক টুকরো আলু এবং তিন, বিরিয়ানির হাঁড়ি মোড়া থাকতে হবে লাল কাপড়ে।

বিরিয়ানির রং হলদেটে কেন? মনস্তত্ববিদরা বলেন, মানুষের ভাষার মতো রঙেরও ভাষা আছে। হলুদ হচ্ছে এমন একটি রং, যা দূর থেকেই সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। এমনকি কম আলোতেও হলুদ রংকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ফলে জাফরান মিশ্রিত বিরিয়ানি যেমন খাবাবের স্বাদ বাড়ায়, তেমনি হলুদ রঙের জন্য বিরিয়ানির প্রতি মানুষ বেশি আকৃষ্ট হয়। সম্ভবত সে কারণেই নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের রাজত্বে, আওয়াধের বিরিয়ানির রং ছিল হলুদ।  

বিরিয়ানিতে আলু: কলকাতার বিরিয়ানি বলতে যা বোঝায়, তার স্বাদ এবং আলুর আগমন ঘটে নবাব ওয়াজিদ আলির হাত ধরেই। আওয়াধের শেষ নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। তিনি ছিলেন একজন সঙ্গীত এবং কবিতাপ্রেমী। ইংরেজদের অত্যাচারে খোয়া যায় রাজপাট। তবে ভারতের মধ্যে নবারের সবচেয়ে পছন্দের স্থান ছিল কলকাতা। আর তাই দু’বছর ইংরেজরা তাকে কারারুদ্ধ করে রাখার পর ১৮৫৬ সালে তারই ইচ্ছানুযায়ী ইংরেজরা নবাবকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়।

ওয়াজিদ আলি স্থান হিসেবে বেছে নেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলটাকে। সেই সময় নবাবের সঙ্গে স্বেচ্ছায় কলকাতায় চলে আসেন তার কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, রাঁধুনিসহ সাধারণ মানুষ। জীবনের শেষ ৩০টা বছর কাটিয়েছিলেন কলকাতাতেই। মেটিয়াবুরুজ গড়ে তোলেন অনেকটা আওয়াধের আদলে। সৌখিন নবাবের গান, বাজনা ছাড়া শখ ছিল ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতরবাজি এবং লোক খাওয়ানো। এ নবাবই জনক ছিলেন কলকাতার চিড়িয়াখানার।

নবাব ওয়াজিদ আলি যখন কলকাতায় আসেন, তখন তার অর্থ স্বচ্ছলতা তেমন ছিল না। যাও ছিল তাও কম নয়। কিন্তু কথায় বলে, বসে খেলে রাজার ধনও শেষ হয়-এমনই অবস্থা হয়েছিল নবাবের। ফলে বেশিদিন মাংস সহযোগে বিরিয়ানি খাওয়াতে পারেননি কলকাতাবাসীকে। তাই বিরিয়ানিতে মাংসের পরিবর্তে যোগ হয় আলু। সে সময় আলু আজকের মত এত সহজলভ্য ছিল না। পর্তুগিজদের হাত ধরে কলকাতায় আসা আলুর দাম ছিল বেশি। সে যুগে আলু মানেই ছিল এলিট লেবেলের সবজি। কিন্তু মাংসের তুলনায় খরচ কম পড়ত। সে যাই হোক, কিছুটা খরচ বাঁচাতে এবং সেই সঙ্গে বিরিয়ানির পরিমাণ বাড়াতে আলুর ব্যবহার শুরু হয়। ওয়াজিদ আলি শাহের সেই বিরিয়ানির ধারা এখনও বয়ে নিয়ে চলছে শহর কলকাতা।

বিরিয়ানির হাঁড়িতে মোড়া লাল কাপড়? দূর থেকেই সংকেত মেলে শহর কোন দোকানে আছে বিরিয়ানি। বলা হয়, লাল-হলুদ-সবুজ ট্রাফিক সিগন্যালের মত ওটা বিরিয়ানি লাভারসদের সিগন্যাল। অপরদিকে, লাল রং হলো ভালবাসার প্রতীক। কারণ হৃদয়ের রং লাল। প্রকৃত ভালোবাসা এ হৃদয় থেকেই আসে।

ইতিহাস বলছে, সম্রাট হুমায়ুন ছিলেন পারস্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। রাজপাঠ হারিয়ে সম্রাট হুমায়ুন ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাকে পারস্য সম্রাট লালগালিচা বা রেড কার্পেটে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এছাড়া ইরানের খাদ্য পরিবেশনার রীতি অনুযায়ী, রুপার পাত্রে খাবার আনা হয় লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে। যা পরে মোগল আমলেও চালু হয়েছিল। খাদ্য পরিবেশনে রঙের এ প্রথা লখনৌয়ের নবাবরাও অনুসরণ করেছিলেন। ফলে অভিজাত্য, বনেদিয়ানা প্রকাশের অন্যতম ধারা হিসেবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে লাল কাপড়ে মোড়া খাবার। আজ বিরিয়ানি সহজলভ্য হলেও, এক সময় কিন্তু ছিল আভিজাত্যেরই প্রতীক। তাই ব্যবহৃত হয় লাল কাপড়।

সবশেষে বলা যায়, হালকা হলদেটে ঘিয়ে মাখানো লম্বা লম্বা সুগন্ধি চাল। তাতে একফালি নরম আলু, সঙ্গে মুক্তোর মত চেয়ে থাকা চকচকে সেদ্ধ ডিম, আর মোলায়েম কয়েক টুকরো মাংস। এ কম্বিনেশন কলকাতা বিরিয়ানি ছাড়া আর কোথাও নেই। সামনে গিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই বিরিয়ানির সুবাসে ভরে ওঠে চারপাশ৷ যা কলকাতায় চলে আসছে দশকের পর দশক ধরে।

 

বাংলাদেশ সময়: ০১০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২১
ভিএস/জিসিজি/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।