ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

নিম্নমানের কাগজ প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে নামছে বিএসটিআই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৯
নিম্নমানের কাগজ প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে নামছে বিএসটিআই

ঢাকা: নিম্নমানের কাগজ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। শিগগিরই ঢাকা ও আশপাশের কাগজ কারখানায় অভিযান পরিচালনা করবে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ নিম্নমানের এসব কাগজ দিয়ে পাঠ্যবই মুদ্রণের ফলে বছরের অর্ধেক না পেরুতেই ছিড়ে যাচ্ছে বই।  বিএসটিআই সনদবিহীন এসব প্রতিষ্ঠান কাগজ ছাপিয়ে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে সরকারকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, প্রতিবছরই এনসিটিবির দরপত্রের বিপরীতে কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান ও বিএসটিআই’র মান সনদবিহীন নিম্নমানের মিল কাগজ সরবরাহ করছে। এসব কাগজে বিদ্যমান বাজারদর এবং এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের তুলনায় অনেক কম দর দিয়ে মানহীন পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে চলেছে কিছু প্রতিষ্ঠান।

বিএসটিআই আইন-২০১৮ অনুসারে, লেখা ও ছাপার কাগজ পণ্যটি সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মান (বিডিএস ৪০৫: ২০১২) অনুযায়ী ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মানসনদ অনুযায়ী বিক্রি, বিতরণ ও বাজারজাত করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে না ওইসব কাগজ উৎপাদনকারী মিল। এ ব্যাপারে বিএসটিআই বারবার সরকারি আইন মেনে চলার তাগিদ দিলেও এনসিটিবি তা মানছে না।

জানা গেছে, আগামী বছর ২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন চার কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই তুলে দেবে সরকার। এসব বই মুদ্রণ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০২০ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও ভোকেশনাল স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৭২টি বই ছাপাচ্ছে এনসিটিবি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য এনসিটিবি দরপত্রের মাধ্যমে কাগজ ক্রয় করে মুদ্রণকারীদের সরবরাহ করে থাকে। আবার কাগজসহ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বাস্তবে দেখা যায়, এ দু’টি ক্ষেত্রেই সবসময় দরপত্র অনুযায়ী মানসম্মত কাগজে বই ছাপানো হয় না।

সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল বিএসটিআই থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, দেশে বতর্মানে ১০৬টি পেপারমিল থাকলেও মাত্র ১৮টি মিল বিএসটিআইয়ের মানসনদ নিয়েছে, যারা নিয়মিত সরকারি রাজস্ব দিচ্ছে এবং মানসম্মত কাগজ ও কাগজ জাতীয় পণ্য উৎপাদন করছে। প্রতিবছর এনসিটিবির ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৭২টি বই ছাপাতে এনসিটিবির প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিকটন কাগজ প্রয়োজন হয়। টনপ্রতি ৮৪ হাজার টাকা প্রাক্কলিত দরে ওই কাগজের বিক্রয় মূল্য ৬৭২ কোটি টাকা। এ কাগজ থেকে বিএসটিআইয়ের মার্কিং ফি পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছে না। এতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের পরিচালক প্রকৌশলী এসএম ইসহাক আলী বাংলানিউজকে বলেন, দেশে বতর্মানে ১০৬টি পেপারমিল থাকলেও মাত্র ১৮টি মিল বিএসটিআইয়ের মানসনদ নিয়েছে। যারা নিয়মিত সরকারি রাজস্ব দিচ্ছে এবং মানসম্মত কাগজ ও কাগজ জাতীয় পণ্য উৎপাদন করছে। প্রতিবছর এনসিটিবির ৩৫ কোটিরও বেশি বই মুদ্রণ করা হয়। তারা যদি মানহীন কাগজ ব্যবহার করে তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করতে বা বলতে পারি না। সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠ্যবই  না মুদ্রণের ফলে বিএসটিআই মার্কিং ফি পাওয়ার কথা থাকলেও তা পাচ্ছে না। এতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ পেপারমিল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ১০৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছে। আমরা তাদের কারখানাগুলোতে তদন্ত করবো। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরে ব্যবস্থা নেবো। ইতোমধ্যে ধামরাইলে অভিযোগের ভিত্তিতে বেইজ পেপার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আমরা সনদবিহীন সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।  

ইসহাক আলী বলেন, বর্তমানে দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত কাগজ দিয়ে দেশের কাগজের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে এ ব্যবসা যাতে মনোপলি না হয় সেজন্য সরকার আমদানি পর্যায়ে একটু সুবিধা দিয়ে থাকে। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আমরা শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, কাগজের মান দেখার জন্য আমরা ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছি। দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মান পরীক্ষা করে কাগজ ছাড় করে ইন্সপেকশন এজেন্ট। ফলে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার কোনো সুযোগ নেই।  

জানা যায়, মূলত সিন্ডিকেট করেই এনসিটিবির বইয়ের কাজ পায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান, যারা বিএসটিআইয়ের মানসনদ ছাড়াই কাগজের মিলে উৎপাদিত নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করে। সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়া এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তাও সবকিছু জেনেশুনেও না জানার ভান করেন। এতে সরবরাহকারী ও মুদ্রাকররা নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করেও পার পেয়ে যান। কিন্তু নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো হলে ছাপার মান খারাপ হয় এবং বই টেকসই হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ে ছাপানো ছবি থেকে কালি উঠে যায়, ছবি বোঝা যায় না। এছাড়া নিম্নমানের কাগজে নানা ধরনের রোগজীবাণু থাকে, যা শিশুস্বাস্থ্য ও চোখের জন্য ক্ষতিকর।

জানা যায়, এনসিটিবিতে মুদ্রণ কাজের তদারককারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটি অংশের সহায়তায় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে রিসাইকেল্ড কাগজ ক্রয় করে নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে।

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি এনসিটিবির গুদামে সরবরাহ করা কাগজ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণাগারে পাঠায়। সেখানে দেখা যায়, এনসিটিবি তার দরপত্রে যে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করেছিলো, সরবরাহ করা কাগজের মান তার চেয়ে নিম্নমানের। কাগজের ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ কমপক্ষে ১২ থাকার কথা থাকলেও পরীক্ষায় পাওয়া গেছে মাত্র ৮ দশমিক ৫৮, ‘ব্রাইটনেস’ কমপক্ষে ৮০ থাকার কথা অথচ আছে ৬৭ দশমিক ৭৮ এবং ‘জিএসএম’ ৬০-এর বেশি থাকার কথা থাকলেও আছে ৫৮ দশমিক ৮৯। আর কাগজ কতোটা মজবুত, কতোদিন টিকতে পারে সেজন্য কাগজের ‘ফেয়ার ফ্যাক্টর’ কতো তা জানা জরুরি। অথচ স্পেসিফিকেশনে এ ধরনের কোনো চাহিদাই নেই।

সাম্প্রতিক সময়েও পরীক্ষা করে বইয়ে ‘জিএসএম’ ৬০-এর বদলে ৪৬ দশমিক ৫৬ এবং ‘ব্রাইটনেস’ ৮৫ শতাংশের বিপরীতে পাওয়া যায় ৬৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

সিএম সনদহীন কারখানার কাছ থেকে নিম্নমানের কাগজ না কিনে শুধু বিএসটিআই মানসনদপ্রাপ্ত কারখানা থেকে কাগজ সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশ পেপারমিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) পক্ষ থেকেও বারবার শিল্পমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও বিএসটিআই মহাপরিচালক বরাবর আবেদন জানানো হয়।  

আবেদনে বলা হয়, এনসিটিবি আইনের তোয়াক্কা না করে বিএসটিআই মান ছাড়াই কাগজ ক্রয় ও বই মুদ্রণ করে চলেছে। এতে একদিকে আইন অমান্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে মুদ্রিত বইয়ের গুণগত মান বজায় থাকছে না। শিক্ষার্থীরা মানসম্মত বই না পাওয়ায় বই উৎসবের মতো সফল অর্জন সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। একইসঙ্গে ভাবমূর্তি নষ্ট ও সিএম লাইসেন্স ফি বাবদ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

এমনকি দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে বিএসটিআই সনদ বাধ্যতামূলক করতে বিপিএমএ একাধিকবার এনসিটিবির কাছে আবেদন জানালেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৩ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৯ 
জিসিজি/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।