ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সাড়ে ১২ লাখ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব বিইএ’র

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯
সাড়ে ১২ লাখ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব বিইএ’র বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত

ঢাকা: ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বৈদেশিক ঋণমুক্ত ১২ লাখ ৪০ হাজার ৯০ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট ঘোষণা করেছে অর্থনীতিবিদদের পেশাদার সংগঠন ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’ (বিইএ)। এতে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৬৯ শতাংশ হবে প্রত্যক্ষ কর ও ৩১ শতাংশ হবে পরোক্ষ কর।

এদিকে আগামী ১৩ জুন (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য ৫ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। বৈদেশিক ঋণমুক্ত এই বিকল্প বাজেট সরকারের সম্ভাব্য বাজেটের দ্বিগুণের বেশি।

২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে নিয়মিত এ প্রস্তাবনা দিয়ে আসছে উন্নয়নশীল বিশ্বে সরকারের বাইরে বিকল্প বাজেট ঘোষণাকারী একমাত্র এ সংগঠনটি।

শনিবার (২৫ মে) রাজধানীর তোপখানা রোডে সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হলে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির পক্ষে এ প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ঢাকাসহ দেশের ২৬টি জেলা শহরে একই দিনে একই সময় এটি অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ।

আবুল বারকাত বলেন, আমাদের এ বছরের বিকল্প বাজেট প্রস্তাবটির এক ভিন্ন মাত্রার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, আর তা হলো আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। এ বাজেট মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালের বাজেট। আসন্ন অর্থবছরের বাজেট হতে হবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন আমাদের ‘স্বাধীনতার ঘোষণার’ সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যপূর্ণ, বাজেট হতে হবে আমাদের ১৯৭২ এর মূল সংবিধানের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দু’টি চেতনা; বৈষম্যহীন অর্থনীতি-সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক মনন-সমৃদ্ধ আলোকিত সমাজ বিনির্মাণ।

আবুল বারকাত বলেন, আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে ২০টি নতুন উৎস নির্দ্দিষ্ট করেছি যা আগে ছিলো না। এর মধ্যে অর্থপাচার রোধ, কালো টাকা উদ্ধার ও সম্পদ কর এই তিনটি নতুন উৎস থেকেই সরকার মোট ৯৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারেন। আর এ টাকা দিয়ে প্রতি বছর তিনটি পদ্মাসেতু করা সম্ভব।

তিনি বলেন, সমিতির প্রস্তাবিত বাজেট অর্থায়নে কোনো বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না, প্রস্তাব অনুযায়ী বাজেটের আয় কাঠামোতে মৌলিক গুণগত রূপান্তর ঘটবে। আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, কেউ হয়তো বলবেন অনেক বড় ঘাটতি। এক্ষেত্রে বলতে চাই জাপানে বাজেট ঘাটতি ২৫৬ শতাংশ। ঘাটতি বাজেটে অসুবিধা হলে এক পয়সা ও ঘাটতি না রেখে আমাদের প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় দিয়েও মোট বাজেট প্রস্তুত করতে পারেন।  

অর্থনীতি সমিতির অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাতওয়ারি সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রস্তাব করেছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে, মোট ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তারপর আছে জনপ্রশাসন, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বাস্থ্যখাত, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাত। চলতি বছরের সরকারি বরাদ্দের চেয়ে বেশি সমিতির প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ অন্যান্য খাতগুলো হলো- কৃষি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস, জনশৃঙ্খলা-নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা।  

কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, আমরা মনে করি যে প্রস্তাবিত বাজেট বছরেই কৃষি ও কৃষক ভাবনার যথার্থতা বিচারে ১ লাখ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ২ লাখ বিঘা কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব, আর পাশাপাশি ২০ হাজার জলাহীন প্রকৃত মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার বিঘা খাস জলাশয় বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে এ লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট পথ নির্দেশনা দেওয়া জরুরি।

কৃষি ফসলের উৎপাদন অঞ্চল গঠন ও কৃষককে কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য দেওয়ার প্রস্তাব করে বারকাত বলেন, এ বছর বোরো ধানে কৃষকের প্রকৃত লোকসান হবে কমপক্ষে ৫০০ টাকা। এ নিয়ে সরকারের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা মনে করি কৃষককে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরিভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারিভাবে সংগ্রহের ক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে, সেক্ষেত্রে এ বছরের বোরো ধানের মণপ্রতি বিক্রয়মূল্য হতে হবে কমপক্ষে ১২০০ টাকা।

দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কিন্তু তার মধ্যে ২০ লাখ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় না উল্লেখ করে ক্রমবর্ধমান মানব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারার অধিকহারে বৈষম্য রোধ, কর্মসংস্থান বাড়ানো ও বেকারত্ব কমাতে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি ‘জাতীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোষ’ গঠন, যুবকদের উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবক হতে উৎসাহিত করতে স্টার্ট আপ পুঁজি সরবরাহ এবং শিক্ষাখাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দেন আবুল বারকাত।

খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে আবুল বারকাত প্রস্তাব করেন, অভ্যাসগত ঋণখেলাপিদের মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে তাদের পূর্ণউদ্যমে চালু শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ঠিক হবে না। সমস্যাটি জটিল তবে সমাধান সম্ভব বলে মনে করি।

আগামী ৩ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৫ লাখ ভ্যাট লাইসেন্সধারীকে ভ্যাটের আওতায় আনার প্রস্তাব করে বলা হয়, এনবিআর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে বাংলাদেশের ভ্যাট লাইসেন্সধারীর সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে বড়জোর ১ লাখ লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে (মোট ভ্যাট লাইসেন্সধারীর ১০ শতাংশ) বর্তমানে ভ্যাট আদায় হয়।

আবুল বারকাত বলেন, সরকার সিগারেট থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, বিড়ি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য থেকে ১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ করতে পারে। এক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে বিবেচনার জন্য আমাদের সুপারিশ হলো সিগারেটের কয়েক স্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তর বাতিল করে প্রতি ১০ শলাকার সিগারেটের ওপর কমপক্ষে ৬০ টাকা আবগারি শুল্ক, প্রতি ২৫ শলাকার বিড়ির ওপর ১৫ টাকা আবগারি শুল্ক, আর প্রতি ১০০ গ্রাম ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যের ওপর ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করা হোক।

সমিতির আরও কয়েকটি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে,  ব্যক্তি পর্যায়ে কর হার কমিয়ে ৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ রাখা, ৫০ শতাংশ নিম্নতর কর দেওয়ার যোগ্য কমপক্ষে ৫০ লাখ টিআইএনধারী মানুষের সংখ্যা বাড়ানো, বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি ব্যক্তিগত আয়কর দেওয়ার যোগ্য মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ হাজারে বাড়ানো, ৩০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা উদ্ধার, অর্থপাচাররোধ থেকে আগামী অর্থবছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায়, নদী দখল ও দূষণ প্রতিকার, প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট উপখাতভিত্তিক কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া, নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সুদবিহীন ঋণ ও বিমা, রেমিট্যান্স প্রবাহকে ফলপ্রদ উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ব্যবহার এবং প্রবাসে কর্মীদের আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ, সার্বজনীন পেনশন, প্রবীণ মানুষদের জন্য ‘প্রবীণ নীড়’ (বৃদ্ধাশ্রম নয়) গড়ে তোলা, পেনশনভোগীদের পেনশনের অর্থ বিনিয়োগের আয় থেকে সব ধররের আয়কর, কর, শুল্ক সম্পূর্ণ রহিত করা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯ 
জিসিজি/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।