ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

করোনায় ধূসর হলুদ তরমুজের স্বপ্ন

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২০
করোনায় ধূসর হলুদ তরমুজের স্বপ্ন তরুণ কৃষক মনিরুজ্জামান মনির

রাজশাহী: ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আবহাওয়া তরমুজ চাষের উপযোগী বলা হয়। কিন্তু উষ্ণ অঞ্চল হওয়ায় রাজশাহীর কোথাও রসালো ফল তরমুজের চাষ হয় না। এরপরও রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমি খ্যাত গোদাগাড়ীতে প্রথম বারোমাসি তরমুজ চাষ করে সফল কৃষকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন মনিরুজ্জামান মনির।

বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান মনিরের কৃষি খামারে এবারও মাচায় চাষ হচ্ছে বিদেশি হানি ডিউ ও রক মেলন জাতের তরমুজ। কিন্তু হালে করোনা সংকটের কারণে তার রঙিন স্বপ্ন ধূসর হয়ে উঠেছে।

তরমুজ বাজারজাতের এই মোক্ষম সময়ে পড়েছে করোনার অশুভ ছায়া। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলন দিয়েও উপযুক্ত দাম উঠছে না। মন্দা বাজার, মজুর ও পরিবহন সংকটের কারণে রাজধানী ঢাকায় পাঠানো যাচ্ছে না উন্নতজাতের এই তরমুজ। অগত্যা রমজান মাসে রাজশাহীর বাজারেই বিক্রি হচ্ছে মনিরের রঙিন স্বপ্ন।

গ্রীষ্মের রসালো ফল তরমুজ। এই গরমে রোজাদারের তৃষ্ণা মেটাতে ইফতারে তরমুজের কোনো জুড়ি নেই। আছে অনেক স্বাস্ব্যগুণও। আর বিদেশি হানি ডিউ ও রক মেলন জাতের উন্নত এই রসালো ফলটি বারোমাসই চাষ করা যায়।

এই দুই জাতের একটি তরমুজের ভেতরে হলুদ বাইরের রং সবুজ। আর একটির ভেতরের রং লাল বাইরে দেখতে হলুদ। মন ভালো করে দেওয়ার একটি খবর হচ্ছে- রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের চৈতান্যপুর গ্রামে গত সাত বছর থেকে এই বারোমাসি তরমুজ চাষ হচ্ছে।  

তরমুজতবে রং বদলালেও এই তরমুজের স্বাদ কিন্তু বদলায়নি। বরং এ তরমুজ আরও মিষ্টি। আরও সুস্বাদু। যারা তরমুজ পছন্দ করেন তাদের কাছে নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। বাণিজ্যিকভাবে এখানে বারোমাসি তরমুজ চাষ চলছে। গোদাগাড়ী উপজেলার আদিবাসী পল্লী হিসেবে পরিচিত চৌতন্যপুরের রঙিন তরমুজ এখন বছরজুড়েই মানুষদের মুখে স্বাদের ভিন্নতা ছড়াচ্ছে।     

রাজশাহীর স্বপ্নবাজ তরুণ কৃষক মনিরুজ্জামান মনির এবার তার মোট ১৭ বিঘা জমির মধ্যে সাত বিঘার ওপর ব্যতিক্রমী এই তরমুজের চাষ করেছেন। এছাড়া থাই পেয়ারা, স্ট্রবেরিসহ বিভিন্ন জাতের নতুন নতুন ফসল চাষের নেশা চেপে আছে এই তরুণের মাথায়। যেই ফসলই নতুন মনে হয় সেই ফসলেরই চাষ শুরু করেন মনিরুজ্জামান মনির।

মনিরুজ্জামান মনিরের বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর মহিষাবাথান এলাকায়। তিনি একজন শৌখিন চাষি। নিজের কোনো আবাদি জমি নেই। জমি ইজারা নিয়ে আবাদ করে থাকেন। এর আগে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে বীজ আলু চাষ করেছেন। স্ট্রবেরি চাষ করেছেন। অন্য জমিতে এবছরও স্ট্রবেরি, পেঁপে ও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গাছে পাকানো টমেটো চাষ করেছেন তিনি।

আর বিশেভাবে চাষ করছেন বারোমাসি তরমুজ। এর মধ্যে হলুদ তরমুজটার আকর্ষণ বেশি। কদিন আগে এই তরমুজ কেটেছেন। বর্তমানে হলুদ ও লাল দুই রঙের তরমুজই পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে কিছু তরমুজ কেটে বাজারে বিক্রির জন্য দিয়েছেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই লাল তরমুজগুলো কেটে ফেলবেন। আর হলদু তরমুজটা আরও ১০/১২ দিন পর কাটতে শুরু করবেন। এই তরমুজ ৭৫ দিনের ফসল। তাই বছরে তিন থেকে চারবার চাষ করা যায়। গত জানুয়ারি মাসে এই তরমুজের বীজ লাগিয়েছিলেন।

জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, সব সময় নতুন ফসল চাষে ঝুঁকি থাকে। এরপরও তিনি বরাবরই নতুনের পেছনেই ছোটেন। এতে কষ্ট বেশি থাকলেও যখন সফলতা আসে তখন ভালো লাগার মাত্রাটাও থাকে অন্যরকম। সাত বছর থেকে চাষবাসের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এখন পর্যন্ত পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই চেতনা থেকেই বরেন্দ্রের মাটিতে বারোমাসি এবং হলুদ রাঙা তরমুজের চাষ শুরু করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এবারই ব্যতিক্রম!

করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার বড় মোকাম রাজধানী ঢাকায় এই তরমুজ পাঠাতে পারছেন না। বাজার মন্দা থাকায় ঢাকার পাইকাররা তরমুজ না নিতে চাওয়ায় রাজশাহীতেই বাজারজাত করতে হচ্ছে। এতে খরচ বাদে পুঁজি উঠলেও আশানুরূপ লাভ হচ্ছে না। রমজান উপলক্ষে এরই মধ্য কিছু তরমুজ কেটে বাজারে দিয়েছেন। এতেই বাজারের লাভ-ক্ষতির অবস্থা আঁচ করতে পারছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুজ্জামান বলেন, মাল্চিং পদ্ধতিতে এই তরমুজ চাষ করা হয়। বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করতে মাচাঙ তৈরি করতে হয়।

এক বিঘা জমিতে এ তরমুজ চাষ করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর বিক্রি করে পাওয়া যায় প্রায় দেড় লাখ টাকা। এক বিঘায় এই তরমুজের ফলন হয় ৬৫-৭০ মণ। আর পাইকারি বাজারে মণপ্রতি বিক্রি হয় দুই থেকে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত।

কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে এখন ভেতরে লাল তরমুজ ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ এবং হলুদ তরমুজ ২ হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। ফলে পাইকারি বিক্রি করলেও প্রতিমণ তরমুজে ৪শ থেকে ৫শ টাকা করে কম পাওয়া যাচ্ছে। এতে ফলন খরচ বাদ দিয়ে পু্ঁজি উঠে আসলেও আশানুরূপ লাভ হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি না থাকলে আর বাজার মন্দা না চললে আকর্ষণীয় এই তরমুজের বিক্রিমূল্য এমন হতো না বলেও দাবি করেন এই সফল কৃষি উদ্যোক্তা।

বিদেশি উন্নত জাতের তরমুজ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঈশ্বরীপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার বাংলানিউজকে বলেন, মাল্চিং পদ্ধতিতে এই তরমুজ চাষ করা হয়। বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করতে মাচাঙ তৈরি করতে হয়। আর শীতকাল বা অন্য সময়ে মাটিতেই তরমুজ চাষ করা যায়। প্রথমবার মাচা তৈরি করলে সেই মাচা এক বছর ব্যবহার করা যাবে। দ্বিতীয়বারের উৎপাদন খরচ কম হবে। রাজশাহীতে মনিরুজ্জামানই প্রথম তরমুজের চাষ শুরু করেছে। অন্যরাও ধীরে ধীরে এই তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০৬ সালে মনিরুজ্জামান বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদকও পেয়েছেন। নতুন ফসল চাষ করা তা নেশা৷ ঝুঁকি থাকলেও সব সময় চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন এই তরুণ চাষি। তাকে সার্বিকভাবে সব ধরনের তথ্য ও কৃষি পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

 

এবারও তার জমিতে ফলন ভালো হয়েছে। সারা বছরই বিশেষ এই জাতের তরমুজ চাষ করা যায়। তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষের ব্যাপকতা সৃষ্টি হলে বারোমাসি তরমুজ কৃষকের জন্য লাভজনক হবে। তবে এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে মনিরুজ্জামানের লাভ কম হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন উপ-সহকারী এই কৃষি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২০
এসএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।