ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

তোকে না বলেছি, যাকে দেখবি সালাম দিবি

শাবিপ্রবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩
তোকে না বলেছি, যাকে দেখবি সালাম দিবি

শাবিপ্রবি, (সিলেট): শিরোনামের লেখাটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বর্তমান এক সিনিয়র শিক্ষার্থীর। ক্যাম্পাসে আসা নবীন এক জুনিয়রকে র‌্যাগ দেওয়ার সময় তিনি কথাটি বলেন।

শাবিপ্রবির র‌্যাগিং ইতিহাস পুরনো। নবীন শিক্ষার্থীদের আগমনকে কেন্দ্র করে এ সংস্কৃতি চালু হয় নতুন নতুন পদ্ধতিতে। পেন ড্রাইভ দিয়ে রাস্তা মাপানো, বড় আপুদের প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি যাকে তাকে দেখলেই সালাম দেওয়ানো, এখন যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে।

জানা গেছে, এ বছর নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসে র‌্যাগিং সংস্কৃতি বেড়েছে মশার পালের মতো। পরিচয়ের নামে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকার ঘটানো অথবা তার মনে হীনমন্যতা তৈরি করে দেওয়াই যেন সিনিয়রদের দায়িত্ব। গভীর রাত পর্যন্ত জুনিয়রদের র‌্যাগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তো পুরনো। এখন বিভিন্ন এলাকায় শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের মেসে গিয়েও জ্যেষ্ঠরা র‌্যাগ দিচ্ছেন। ক্লাসরুমের নোংরা পরিচয় পর্বের কথা তো নতুনদের ফেসবুকেই দেখা যায়।

নবীনদের অভিযোগ, যেখানে যাকে পাচ্ছেন, সিনিয়ররা তাদের অপসংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছেন। মাত্রই যারা সিনিয়র হলেন, তারাও তারে জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে বসে নতুনদের র‌্যাগ দিচ্ছেন। এ সংস্কৃতি নিয়ে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের তেমন কোনো কার্যকারিতা দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে দুয়েকজনকে অফিসে ডেকে পাঠানো বা নোটিশ করা ছাড়া আর কোনো কিছু করা হয় না। মূলত, প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষকে কোনো তোয়াক্কা না করেই জ্যেষ্ঠদের দ্বারা কনিষ্ঠরা নিপীড়িত হচ্ছেন!

গত ৭ ফেব্রুয়ারি নতুনরা (২০২১-২২ সেশন) ক্যাম্পাসে যাওয়ার পর অনেকেই ছাত্র আবাসিক হলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপে উঠেছে। অনেকেই সিট না পেয়ে আশপাশের মেসে উঠেছেন। নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ও ও এর বাইরে অন্তর্ভুক্ত হল, হোস্টেল বা মেসে ভাড়া উঠেছেন। প্রায় প্রতিটি জায়গায় পরিচয়ের নামে গভীর রাত (৩টা থেকে ৪টা) পর্যন্ত রুমে আটকে রেখে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। র‌্যাগিংয়ের মাত্রা আবাসিক হলগুলোয় বেশি বলেও অভিযোগ করেছেন নতুনরা।

একাধিক নবীন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, পরিচয়ের নামে জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা তাদের দিয়ে সাথে কথা বলে জানা যায়, হলের বিভিন্ন গ্রুপের সিটে ওঠা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি রাতে কোনো না কোনো রুমে গিয়ে পরিচিত হয়ে আসতে হয়। পরিচয় হতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন অশালীন শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, ইশারা-ইঙ্গিত, নাচ-গান, বিভিন্ন রকমের হাসি, অভিনয়, সিনেমার ডায়ালগ, অশ্লীল ভিডিওসহ হরেক রকমের অভিনয় করে দেখাতে বলেন সিনিয়ররা। তাদের কথায় এসব করতে অসম্মতি জানালে ব্যাচ বয়কট, বিপদে পাশে না দাঁড়ানো, নোট না দেওয়া এমনকি ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার হুমকিও দেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নবীন বলেন, নতুন হওয়ায় এসব অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। আমাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, ভয়ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের অভিভাবকরাও চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি আমাকে র‌্যাগ দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। আমাকে বলা হয়েছে যাতে সামনে পাবো, তাকেই সালাম দিতে হবে। এদিক-সেদিক হলে আবারো ডেকে নিয়ে বলে ‘তোকে না বলেছি, যাকে দেখবি সালাম দিবি’ এ বলে আবারো রুমে ডেকে নিয়ে হয়রানি করে!

আরেক শিক্ষার্থী জানান, ক্যাম্পাসে কাপড় পর্যন্ত খুলিয়েছেন সিনিয়ররা। হাঁটু মুড়ে সিনিয়র আপুকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বলা হয়। ঠিকমতো না করতে পারলে বার বার করতে বলা হয়। আরও এমন কিছু করা হয়, মুখে বলা বা লেখা সম্ভব না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করেন। অর্থাৎ, তাদের প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; এমন পরিস্থিতিতে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে; এমন পরিস্থিতিতে কেউ পড়লে ভুক্তভোগীরা যাতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এসব কথা ছাড়া বলার মতো নতুন কোনো কথা তারা বলেন না।

র‌্যাগিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি সজাগ অবস্থানে রয়েছে বলেছে দাবি করেন ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক আমিনা পারভীন। কিন্তু তারপরও এ ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেই যাচ্ছে। বন্ধের উপায় কি প্রশ্নে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন স্থানে র‌্যাগিং নিষিদ্ধ সংবলিত ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে মোবাইল নাম্বার দেওয়া আছে। এর পরও যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে, সেক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

র‌্যাগিংয়ের ব্যাপারে শাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, র‌্যাগিংয়ের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে। গত বুধবার প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিংয়ের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করতে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা হলের প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডি, সকল বিভাগীয় প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছি। যারা র‌্যাগিংয়ে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরণের ছাড় দেওয়া হবে না।

র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা হলেন, ব্যবসায় প্রশাসনের বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের মো. আপন মিয়া, মো. আল আমিন, মো. পাপন মিয়া, মো. রিয়াজ হোসেন ও মো. আশিক হোসেন। বহিষ্কারাদেশ থাকায় তারা ক্যাম্পাসে বিচরণ করতে পারবেন না এবং তাদের হলের সিট বাতিল থাকবে।

যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অধিকতর তদন্তের পর পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. খায়রুল ইসলাম, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মাজহারুল হাসান মজুমদার, সৈয়দ মুজতবা আলী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আবু সায়েদ আরফিন খান নোবেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট সহকারী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান খান ও সহকারী প্রক্টর মিজানুর রহমান।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।