ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

দুদকের মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের ৩ শিক্ষক কারাগারে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৩
দুদকের মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের ৩ শিক্ষক কারাগারে

সাতক্ষীরা: জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রতারণা, জালিয়াতি ও তথ্য গোপনের মাধ্যমে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের তিন শিক্ষককে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

এছাড়া অসুস্থতাজনিত কারণে একজন শিক্ষকের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে।

তবে পলাতক রয়েছেন মামলার প্রধান আসামি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদ।

সোমবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে সাতক্ষীরার বিশেষ আদালতে চার আসামি আত্মসমর্পণ করেন। সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক, জেলা ও দায়রা জজ চাঁদ মো. আব্দুল আলীম আল রাজী শুনানি শেষে তিনজনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর ও একজনের আবেদন মঞ্জুর করেন।

জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হওয়া আসামিরা হলেন- আশাশুনির নাকতাড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ সরদারের ছেলে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান, সদর উপজেলার নেবাখালি গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে দর্শন বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ এবং সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ধীরেন্দ্র্র নাথ সরকারের ছেলে হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষক অরুণ কুমার সরকার।  

এছাড়া দেবহাটার উত্তর পারুলিয়া গ্রামের দেলবার মৃধার ছেলে সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মনিরুল ইসলামকে জামিন দেওয়া হয়েছে।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান দিলু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে চার প্রভাষককে এমপিওভুক্ত করার মাধ্যমে ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসামিদের নামে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাস ২০২২ সালের ৯ মার্চ খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা (৩/২০২২) দায়ের করেন। যা পরে সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতে ২/২০২২ নম্বর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের খুলনা অফিসের সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায় চলতি বছরের ৫ মে আদালতে মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত ২৬ অক্টোবর অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে রেজুলেশন জালিয়াতি করে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২৪ জন শিক্ষককে নিয়োগ ও ২১ জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট তদন্ত শুরু করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাস। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুকুমার দাসের কাছ থেকে দুদক সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দুর্নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন। অভিযুক্ত ২১ জন প্রভাষক ও অধ্যক্ষ আবু সাঈদকে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফায় দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নেওয়া হয় তাদের লিখিত জবানবন্দি। পরে বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মনিরুল ইসলাম, দর্শন বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান এবং হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অরুণ কুমার সরকারের কাগজপত্র জাল বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়।

২০১৯ সালের ২৪ জুলাই দুদকের হটলাইনে সিটি কলেজের এমপিও বঞ্চিত এবং কলেজ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিতাড়িত বিধান চন্দ্র্র দাসসহ অন্যান্যদের অভিযোগের পর ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারির পর থেকে এসব শিক্ষককে তদন্ত কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হয়। অভিযুক্ত চারজন প্রভাষকের অনার্স শাখায় নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য জালিয়াতি করে ডিগ্রির তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ওই বছরের ২৯ নভেম্বর নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়। ৪ ডিসেম্বর এক পরিপত্রে ওই বোর্ডের মাউশি প্রতিনিধি হিসেবে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি এলপিআরে যাওয়া অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দেখানো হয় যুদ্ধাপরাধ মামলায় সেই সময় জেলে থাকা মাওলানা আব্দুল খালেক মণ্ডলকে। ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ওই চারজন শিক্ষকের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। যদিও ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ওই চার প্রভাষকের নিয়োগের সময় আব্দুল খালেক মণ্ডল সভাপতি ছিলেন না। ২০০২ সালের ২৪ জুন থেকে ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট পর্যন্ত তিনি সভাপতি ছিলেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, তৎকালীন অধ্যক্ষ ইমদাদুল হকের সময় ওই চারজন প্রভাষকের নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশন দেখালেও শুধুমাত্র কৃষি ডিপ্লোমার শিক্ষক আবু রায়হান ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০০৫ সালে। অন্য তিনজনের রেজুলেশন তার নয় বলে তদন্তে জানা যায়। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর রূপালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে সিটি কলেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন তালিকায় অধ্যক্ষ হিসেবে ইমদাদুল হক ও সভাপতি হিসেবে তৎকালীন সংসদ সদস্য এমএ জব্বারের স্বাক্ষর দেখা যায়।

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, ব্যান বেইসের তথ্য অনুসারে মো. মনিরুল ইসলামের প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর। এসএম আবু রায়হানের যোগদানের তারিখ ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ। মো. নাসির আহম্মেদের প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০১৬ সালের পহেলা ডিসেম্বর ও অরুণ কুমার সরকারের যোগদানের তারিখ ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এ শিক্ষকদের যোগদানের তারিখ জালিয়াতি করে মনিরুল ইসলাম ও অরুণ কুমার সরকারের যোগদান ২০০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, এসএম আবু রায়হান ও নাসির আহম্মেদের যোগদান দেখানো হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর।


মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির আগে ডিগ্রি স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। এ পরিপত্র জারির পরপরই অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ওই চার শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিওভুক্তির জন্য অফ লাইনে মাউশি বরাবর আবেদন করেন। এরই আলোকে তারা ২০১৯ সালের নভেম্বর এমপিওভুক্ত হন। অধ্যক্ষ আবু সাঈদের যোগসাজশে ওই চারজন শিক্ষক ২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বেতন ভাতা বাবদ ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা রূপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে তুলেছেন।  

সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমানে আরও ১২ জন শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিওযোগ্য নামের তালিকাভুক্ত করার অভিযোগে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই থেকে ১২ জুলাই দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা তাদের ডেকে নিয়োগ সংক্রান্ত সব তথ্য উপাত্ত রেকর্ড করেন। এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আজিম খান শুভসহ চারজনের নামে দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও বেতন ভাতার পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়।

সম্প্রতি সাতক্ষীরার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিয়ন, নাইট গার্ড থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১০ লাখ টাকা থেকে ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাগবাটোয়ারার এক অলিখিত সিস্টেম গড়ে উঠেছে। আর এ সিস্টেমের ফলে বছরের পর বছর বিনা বেতনে চাকরি করেও বহু ননএমপিওভুক্ত শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারেন না। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ব্যবসার বড় অংশ চলে গেছে স্থানীয় এক শীর্ষ জনপ্রতিনিধির পকেটে। বর্তমানে সাতক্ষীরার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই ধারা অব্যাহত।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।