ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

সুনাম ও সমস্যায় আবদ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

মাহবুবুর রহমান মুন্না, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১২
সুনাম ও সমস্যায় আবদ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

খুলনা: সুনাম ও সমস্যার বেড়াজালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়(খুবি)। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

মহানগরী খুলনা থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ূর নদীর পাশে এক নয়নাভিরাম পরিবেশে গল্লামারীতে ১০১.৩১৬ একর জমির ওপর এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত।

তবে, অবাক করা ব্যাপার হলো, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-বিষয়ক পরিচালকের দপ্তরের জারি করা শিক্ষার্থী আচরণ বিষয়ক নীতিমালা অনুসারে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু, শিক্ষকদের জন্য রাজনীতির বিষয়ে কোনো ধরনের বাধ্য-বাধকতা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি: ১৯৭৪ সালে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে খুলনা বিভাগে উচ্চ শিক্ষার্থে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন সরকারের কেবিনেটে খুলনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অধ্যাদেশ ৫(১)জি ধারামতে, খুলনা বিভাগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ১৯৮৩ সালে সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করা হয়। পরে ১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এরপর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি এক গেজেটে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯৮৯ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রকল্প পরিচালক এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর একাডেমিক কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ওই বছর থেকে মোট ৪টি ডিসিপ্লিনে ৮০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে।
এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি সন্ত্রাস, সেশনজটমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করে আসছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। এর মধ্যে বিদেশি ছাত্রছাত্রীও রয়েছেন।
বিশাল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজিতা, খান জাহান আলী ও খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ নামে ৩টি আবাসিক হল রয়েছে। তবে আসন সংখ্যা মাত্র ৯শ ৮০টি। এটিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা।

এদিকে, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ও ভবিষ্যতের চাহিদার নিরিখে এখানে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা, এনভায়রমেন্টাল সায়েন্স ও বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে দেশে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু করা হয়।
এ ছাড়া স্থাপত্য ও ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স ঢাকার বাইরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের পরেই ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি চালু হয়।

বর্তমানে এখানে ৫টি স্কুলের (অনুষদ) অধীনে ২১টি ডিসিপ্লিন (বিভাগ), একটি ইনস্টিটিউটে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ব্যাচেলর ডিগ্রি, ব্যাচেলর অব অনার্স ডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রি, এমফিল ও পিএইচডি দেওয়া হয়।

স্কুলগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের অধীনে রয়েছে আর্কিটেকচার, আরবান অ্যান্ড রুরাল প্ল্যানিং, কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, পদার্থ, রসায়ন বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন।

জীববিজ্ঞান স্কুলের অধীনে রয়েছে- ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রোটেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফার্মেসি ও সয়েল সায়েন্স ডিসিপ্লিন।

এছাড়াও ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন স্কুলের অধীনে ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, কলা ও মানবিক স্কুলের অধীনে ইংরেজি ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিন, সমাজ বিজ্ঞান স্কুলের অধীনে অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান ও ডেভিলপমেন্ট ডিসিপ্লিন রয়েছে। একমাত্র ইনস্টিটিউটের নাম- চারুকলা ইনস্টিটিউট।

এছাড়া সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দ্য সুন্দরবনস (সিআইএসএস), রিসার্স সেল, মডার্ন ল্যাংগুয়েজ সেন্টার ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ শিক্ষা ও গবেষণা কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সমস্যা:
শিক্ষার্থীরা বাংলানিউজকে জানান, বিশ্ববিদ্যালটিতে নতুন নতুন ডিসিপ্লিন চালু হচ্ছে। শিক্ষার্থীও বাড়ছে। কিন্তু, বাড়ছে না আবাসিক হল, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও পরিবহন সুবিধা; যার কারণে ত্রিমুখি সঙ্কটে পড়েছেন এখানকার শিক্ষার্থীরা।

আবাসন সমস্যা:
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে এর ভৌতসমস্যাও। বর্তমানে আবাসন, পরিবহনসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আবাসন সমস্যা নিয়ে অপরাজিতা হলের শিক্ষার্থী অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের শাম্মী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘তৃতীয় বছরে এসে হলে সিট পেয়েছি। তাও আবার ডাইনিং রুমে!’

একই হলের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মৌ চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, ব্যাচেলর মেয়েদের নগরীতে বাসা ভাড়া দিতে চান না বাড়িওয়ালারা; যে কারণে হলের গণরুমে থাকেন তিনি।

কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মারুফ খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘হলে আসনের অপেক্ষায় ২ বছর মেসে ভাড়া ছিলাম। প্রতিমাসে সেখানে থাকা ও খাওয়ার জন্য আমাকে ৭ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে, যা বহন করা আমার পরিবারের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর!’

এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মো. শামীম বাংলানিউজকে বলেন, ‘৩ বছরেও হলে সিট পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে মেসের ভাড়া বেশি হওয়ায় একটু দূরে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু, যে সময়ে ক্লাস থাকে, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি থাকে না। ‘

গণিত ডিসিপ্লিনের ছাত্র বায়েজিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এসব সমস্যা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালটিতে টিএসসি, বৃহৎ অডিটরিয়াম ও আধুনিক খেলার মাঠ নেই; যার কারণে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সাংস্কৃতিক, বিনোদন ও খেলাধুলায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি। ‘

একমাত্র ছাত্রী হল অপরাজিতা হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মোসাম্মৎ হোসনে আরা বাংলানিউজকে জানান, তার হলে ২শ ৮৮টি আসন রয়েছে। অথচ এর বিপরীতে তাকে প্রায় ২ গুণ ছাত্রী রাখতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য তাকে বাধ্য হয়ে হলের ডাইনিং রুম, গণরুম ও টিভি রুমে থাকতে দিতে হচ্ছে।

একই সমস্যা খান জাহান আলী হলেও। এ হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. শেখ জুলফিকার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তার হলে ৪শ ৪টি আসন আছে। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট কাটাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।

এদিকে, খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মো. সারওয়ার জাহান বাংলানিউজকে জানান, তার হলে ২শ ৮৮টি আসন আছে। এ আসনের বিপরীতে প্রায় দ্বিগুণের বেশি শিক্ষার্থী হলে থাকে।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহ্ বাংলানিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের জন্য নতুন হল নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া পুরনো হলগুলোর তলা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। ‘
তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের সব সংকট নিরসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পাঠক আগামীকাল সোমবার খুলনা মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন দেখতে বাংলানিউজ ভিজিট করুন।


বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।