ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ: সংকটেও ভালো ফল!

জিয়া উদ্দিন দুলাল, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২
হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ: সংকটেও ভালো ফল!

হবিগঞ্জ: শিক্ষকের সৃষ্ট পদের অভাবে মাস্টার্স কোর্স চালু না হওয়া; শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক অপ্রতুল; কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন সংকট নিয়ে চলছে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজ।

এরপরও এসব সংকটকে মাড়িয়ে কলেজটি পরীক্ষার ফলাফলে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে বহু বছর ধরে।



প্রতিষ্ঠাকাল ও নামকরণ: ১৯৩১ সালের মাঝামাঝি সময়ে শহরের রাজনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩ বার নাম বদল করা হয় কলেজটির। প্রতিষ্ঠালগ্নে এটির নাম ছিল- ‘হবিগঞ্জ কলেজ’। এরপর আর্থিক সংকটে পড়লে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গল গ্রামের জমিদার বৃন্দাবন চন্দ্র দাশ ১০ হাজার টাকা দান করেন। তখন তার নামে কলেজটির নতুন নাম হয় ‘বৃন্দাবন কলেজ’। পরে ১৯৭৯ সালে জাতীয়করণ হলে তা ‘বৃন্দাবন সরকারি কলেজ’ নামে পরিচিতি পায়।

কোর্স চালুর সময়: ১৯৩৩ সালে প্রথম এ কলেজের শিক্ষার্থীরা এইচএসসি (মানবিক) পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৯৩৯-১৯৪০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিএ (পাস), ১৯৪০-১৯৪১ শিক্ষাবর্ষে বিএ (অনার্স), ১৯৪৯-১৯৫০ শিক্ষাবর্ষে এইচএসসি (কমার্স) এবং ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিএসসি (ডিগ্রি) কোর্স চালু হয়।

পাঠ্য বিষয়: কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে (মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা, হিসাববিজ্ঞান) বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সাধারণ ইতিহাস, ইসলামি শিক্ষা, যুক্তিবিদ্যা, কম্পিউটার শিক্ষা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, গণিত, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ, অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভূগোল, ব্যবসায় উদ্যোগ, ব্যবহারিক ব্যবস্থাপনা ও কম্পিউটার শিক্ষা বিষয় চালু রয়েছে।

এ ছাড়া অনার্স পর্যায়ে বাংলা, দর্শন, ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, পদার্থ বিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্থনীতি, গণিত ও ইংরেজি বিষয় চালু রয়েছে।

চালু হচ্ছে না মাস্টার্স কোর্স! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কলেজে পদে নিয়োগের অভাবে মাস্টার্স কোর্স চালু করা যাচ্ছে না। মাস্টার্স কোর্স চালুর জন্য প্রতিটি বিষয়ের বিপরীতে কমপক্ষে ৭ জন শিক্ষক থাকার কথা। অথচ এখানে ইংরেজি এবং বাংলা বিষয়ে সর্বোচ্চ ৬টি পদ রয়েছে; যে কারণে মাস্টার্স কোর্স চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক কম: হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা কলেজটির বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১১ হাজার। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ২ হাজার ৫শ, ডিগ্রি পর্যায়ে ৪ হাজার এবং অনার্স পর্যায়ে ৫ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন।

এ শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য কলেজে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষসহ ৬৭টি সৃষ্ট পদ রয়েছে। এর মধ্যে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে ২ জন, অধ্যাপক ১ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৮ জন, সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ১১ জন এবং ২৫ জন প্রভাষক কর্মরত আছেন।

ইতোমধ্যে, আরও ৩৮টি পদ সৃষ্টির দাবি জানিয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন অধ্যক্ষ বিজিত কুমার ভট্টাচার্য। কলেজের লাইব্রেরিয়ানের পদটিও অনেকদিন ধরে শূন্য রয়েছে।     

কলেজে ভবন সংকট: বাঁশের তৈরি একটি চালাঘর এবং এক কক্ষ বিশিষ্ট পাকা ঘর দিয়ে যাত্রা শুরু করে কলেজটি। বর্তমানে ২.৬৯ একর জমির ওপর একতলা বিশিষ্ট ২টি, ২তলা বিশিষ্ট ১টি, ৩তলা বিশিষ্ট ১টি একাডেমিক ভবন, ২তলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন, একটি মিলনায়তন এবং ছেলেদের জন্য ৩তলা বিশিষ্ট একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।

এ ছাড়া ৫তলা বিশিষ্ট আরও একটি একাডেমিক কাম পরীক্ষার হল, ৩তলা বিশিষ্ট ছাত্রীনিবাসের নির্মাণ কাজ চলছে।

এরপরও কলেজে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন সংকট রয়েছে। প্রয়োজনীয় ক্লাম রুম না থাকায় ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের স্থান সংকুলান হয় না। এ ছাড়া কলেজ অধ্যক্ষ ছাড়া অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মচারীদের ডরমেটরি বা বাসভবন নেই।

সন্তোষজনক ফলাফল: কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভালো ফলাফল করে আসছে। উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি এবং অনার্স সব বিভাগের ফলাফলই ভালো।

২০১২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় বৃন্দাবন সরকারি কলেজ সিলেট বিভাগের সেরা-২০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় অষ্টম স্থান লাভ করে। এ বছর ১ হাজার ১শ ৫১ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে ১ হাজার ৩০ জন পাস করেন। জিপিএ-৫ পান ১শ ২৪ জন। পাসের হার ছিল শতকরা ৮৯.৪৮ ভাগ।

সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১০ সালের ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রাইভেট মিলিয়ে ৫শ ১১ জন পরীক্ষার্থীর ৩শ ৫৭ জন কৃতকার্য হন। পাসের হার ছিল ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে বিএ পরীক্ষায় ৩শ ২৪ জনের মধ্যে ২শ ৩১ জন,  বিএসএস পরীক্ষায় ১শ ৩১ জনের মধ্যে ৯৪ জন, বিএসসি পরীক্ষায় ১০ জনের মধ্যে ৯ জন এবং বিবিএস পরীক্ষায় ৪৬ জনের মধ্যে ২৩ জন কৃতকার্য হন। পাসের হার বিএ (পাস কোর্স) ৭১ শতাংশ,  বিএসএস ৭২ শতাংশ, বিএসসি ৯০ শতাংশ এবং বিবিএস পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ।

অনার্সের ফলাফল আকাশ ছোঁয়া: সর্বশেষ প্রকাশিত অনার্স ২০০৯ সালের পরীক্ষার্থীদের সাফল্য ছিল আকাশ ছোঁয়া। এ বছর ৩শ ৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই কৃতকার্য হন। এর মধ্যে হিসাববিজ্ঞানে ৬ জন, ব্যবস্থাপনায় ৪ জন এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ২ জন পরীক্ষার্থী প্রথম শ্রেণী পান।

কলেজে শিক্ষক স্বল্পতা ও ছাত্রছাত্রীদের চাহিদাসম্পন্ন বিষয় বেশি না থাকলেও ভর্তির ক্ষেত্রে হবিগঞ্জের ছাত্রছাত্রীদের প্রথম পছন্দ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ। জেলা পর্যায়ের অপেক্ষাকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরাই এ কলেজে ভর্তি হন। শিক্ষক স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে পারলে শুধু অনার্স নয়, সব কোর্সেই শতভাগ পাসের হার আশা করেন ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা।

এ ব্যাপারে দর্শন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ঈশিতা বর্মণ বাংলানিউজকে বলেন, “কলেজে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে কলেজে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। আমাদের বিভাগে মাত্র ২ জন শিক্ষক রয়েছেন। ভালো ফল পেতে হলে আরও শিক্ষক দরকার। ”

বিএ ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক রুবেল আহমেদ চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, “কলেজে মাঝে-মধ্যে বহিরাগতরা এসে সমস্যার সৃষ্টি করে। কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নিলে ছাত্রছাত্রীরা এ সমস্যা থেকে রেহাই পাবে। ”

অনার্স হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক বাদল মিয়া বলেন, “কলেজে শিক্ষকের সংকট রয়েছে। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে এ সংকট দূর করতে হবে। ”

শিগগিরই মাস্টার্স কোর্স চালুর দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “হবিগঞ্জের ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করে অনতিবিলম্বে মাস্টার্স কোর্স চালু করা প্রয়োজন। কারণ, হবিগঞ্জের যেসব শিক্ষার্থী মাস্টার্সের জন্য জেলার বাইরে লেখাপড়া করে, তাদের মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই, সরকারের কাছে আবেদন, এ কলেজে মাস্টার্স কোর্স চালু করা হোক। ”

এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ বিজিত কুমার ভট্টাচার্য্য বাংলানিউজকে বলেন, “কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। শ্রেণীকক্ষ কম। প্রয়োজনীয় একাডেমিক ভবনের অভাবে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের গাদাগাদি করে বসতে হয়। এ ছাড়া শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে। কলেজে ২০টি শিক্ষকের পদ খালি। ওই পদগুলো পূরণসহ আরও ৩৮টি পদ সৃষ্টির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। ”

“ছাত্র ও ছাত্রীনিবাসে ওঠার জন্য ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর আবেদন রয়েছে। সিটের অভাবে তাদের আবেদন গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। শিগগিরই আরও একটি ৩তলা বিশিষ্ট ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হলে দূরের ছাত্রদের ছাত্রাবাসে থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। ”

অধ্যক্ষ বিজিত কুমার ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, “কলেজে স্থানীয় শিক্ষকের অভাব রয়েছে। যেহেতু, তারা দূর-দূরান্ত থেকে আসেন, হবিগঞ্জে তাদের মন বসে না। আবার যত দ্রুত সম্ভব বদলি হয়ে চলেও যেতে চান। তাই, কলেজে শিক্ষার মান ও হবিগঞ্জে উচ্চ শিক্ষিতের হার বাড়াতে হলে স্থানীয় শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ”

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বাংলানিউজকে বলেন, “বৃন্দাবন কলেজে শিক্ষক সমস্যা রয়েছে। আমরা প্রতিটি মাসিক মিটিংয়েই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। ”

তিনি আরও বলেন, “শিক্ষকরা আরও আন্তরিক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করলে কলেজে শিক্ষার মান আরও বাড়বে। এ ছাড়া শুধুই শিক্ষক নয়, লেখাপড়ার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরও আন্তরিক হতে হবে। ”

তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “শিক্ষার্থীদের মারামারি বন্ধ করতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। কারণ, লেখাপড়াই তাদের আসল কাজ। তাহলেই বৃন্দাবন কলেজ তথা হবিগঞ্জে শিক্ষার মান বাড়বে। ”

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

আগামীকাল বৃহস্পতিবার পড়ুন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট সরকারি কলেজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।