ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

নন এমপিও শিক্ষকরা রাজপথে, গা নেই সরকারে

ইসমাইল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১২
নন এমপিও শিক্ষকরা রাজপথে, গা নেই সরকারে

ঢাকা: মো. রুহুল কুদ্দুস। অতিকায় শ্মশ্রুমণ্ডিত এই ব্যক্তির ৫ জনের সংসার।

বাস্তুভিটার ২০ কাঠার ১০ কাঠা বন্ধক রেখে সরকারি বেতনের আশায় খরচাপাতির টাকা দিয়েছেন মাদ্রাসায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, এভাবে কেটে গেছে অনেক দিন; কিন্তু বেতন হয়নি। বেতনের আশায় এখনও মাদ্রাসায় পড়ান, সংসার চালাতে কামলা(দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে) দেন পরের জমিতে।

কিন্তু তিন ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা এবং সংসারের খরচ চালাতে না পেরে বেতনের দাবিতে চলে এসেছেন রাজধানীতে। মাথায় কাফনের কাপড় পরে মিছিল-মিটিং করছেন রাজপথে। রাত কাটাচ্ছেন ফুটপাতে, কিন্তু টনক নড়েনি সরকারে।

যশোরের মনিপুর ইত্তা সুইচগেট মাদ্রাসার এই শিক্ষক রুহুল কুদ্দুসের মতো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষক তিন দিন ধরে রাজধানীতে অবস্থান ধর্মঘট করছেন। যাদের অধিকাংশই এখন সংসারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

আন্দোলনরত শিক্ষকবৃন্দ জানান, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪ হাজার ৪৮৪টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভূক্তির দাবি জানিয়ে আসছেন। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেও কোনো আশ্বাস মেলেনি। সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষাসচিবের সঙ্গে বসলেও তিনি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি।


এরপর থেকেই সারা দেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ‘নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট’র ব্যানারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। প্রতিদিনই তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাফনের কাপড় পরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।

বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিতে গেলে শাহবাগ শিশুপার্কের সামনে বাধা দেয় পুলিশ। সেখানেই বসে-শুয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। এসময় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে নীলফামারির জালাল হোসেনসহ কয়েক শিক্ষক আহত হন। পরে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দেন।

সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের সঙ্গে শিক্ষকপ্রতিনিধির বসার কথা থাকলেও তার সাক্ষাত পাননি। সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবের সামনে বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষকরা।

চলতি অর্থবছরের মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভূক্ত, স্বীকৃতির সময় থেকে চাকরির বয়স গণনা এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল প্রতিষ্ঠান এমপিওভূক্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন না দেওয়ার দাবিতে বৃহস্পতিবার শিক্ষকবৃন্দ সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি রয়েছে তাদের।

শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জানান, দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসলেও বর্তমান সরকার মাত্র ২০০৯ সালে ১ হাজার ৬০৮টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভূক্ত করেছে। কিন্তু বাকীগুলোর ব্যাপারে সরকার কিছু করছেনা।

শিক্ষক নেতৃবৃন্দ আরও জানান, সাড়ে চার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিটিতে রয়েছে গড়ে ৩শ’ করে শিক্ষার্থী।

তারা দাবি করেন, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের সামান্য একটি অংশ শিক্ষক-কর্মচারীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেও অধিকাংশগুলোতে কোন বেতন নেই। শিক্ষকরা ক্ষুধা পেটে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু এখন তাদের পিঠ দেয়ালে টেকে গেছে। বাধ্য হয়ে রাজপথে নেমেছেন। এমপিওভূক্ত না হলে ঘরে ফিরবেন না তারা।

এদিকে শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায়েও দাবি পূরণের ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই।

গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, “প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংখ্যার পাশাপাশি শিক্ষাখাতে আর্থিক চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের আর্থিক সমক্ষতা কম থাকায় একসঙ্গে সবার চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। শিক্ষকদেরও এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। ”

তবে তিনি বলেন, “এমপিও সুবিধার বাইরে যারা আছেন তাদের বিষয়ে খুব শিগগিরই সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ”

শিক্ষামন্ত্রী জানান, “বর্তমানে দেশে ২৭ হাজার ৪২৬টি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এটা এ খাতের বরাদ্দের ৬০ শতাংশ। এ সরকারের আমলে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। ”

শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থমন্ত্রীও একমত পোষণ করেছেন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনরত শিক্ষকদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

তবে নন এমপিও শিক্ষকদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না থাকায় বাড়ি ফিরতে নারাজ আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীরা।

যশোরের শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস জানান, সারা দিন আন্দোলন করে রাতে ফুটপাতে ঘুমান তারা। দাবি পূরণ হলেই তারা ঘরে ফিরবেন।

শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় আহত নীলফামারির শিক্ষক জালাল হোসেন সন্ধ্যায় ছেড়া শার্ট গায়ে প্রেস ক্লাবের সামনে বলেন, “আমরা আর চলতে পারছি না, এমপিও না হলে ঘরে ফিরব না। ”  

সিরাজগঞ্জের রাজিবপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবু লাইস মানবিক দিক বিবেচনায় হলেও কষ্টে থাকা শিক্ষকদের বিষয় বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
 
নন এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি মো. এশারত আলী বাংলানিউজকে বলেন, “দীর্ঘদিনেও দাবি পূরণ না হওয়ায় অনেক শিক্ষক বেতন না পেয়েই অবসরে গেছেন। বাধ্য হয়ে এখন শিক্ষক-কর্মচারীরা রাস্তায় নেমেছেন। দাবি বাস্তায়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ”

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।