ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস বুধবার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪
ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস বুধবার

ঢাকা: ১৭ সেপ্টেম্বর, বুধবার, শিক্ষা দিবস। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের প্রতীক ঐতিহাসিক ‘শিক্ষা দিবস’।

শিক্ষার জন্য সংগ্রাম ত্যাগ, বিজয়, গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক এ শিক্ষা দিবস।

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিভূ সামরিক শাসক জেনারেল আয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল তথাকথিত জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করে সবার জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণমুখী বিজ্ঞানমনস্ক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সহজলভ্য আধুনিক শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা অর্জনের লক্ষে ছাত্রসমাজ অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে আয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আগস্ট মাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বরের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।

ছাত্রসমাজের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রসমাজের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানেও প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ ও জনগণের মধ্যেও বিক্ষোভ এবং আন্দোলন প্রসারিত হতে থাকে।

১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক আয়ুব খান তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। এই কমিশন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আয়ুব সরকার এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এই তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’তে যেসব বিষয় সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- শিক্ষাকে ব্যয়বহুল পণ্যের মতো শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানদের স্বার্থে উচ্চ শিক্ষাকে সীমিত করা এবং সাধারণের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত করে ফেলা।

শিক্ষাব্যয় পুঁজিবিনিয়োগ হিসেবে দেখে, যে অভিভাবক বেশি বিনিয়োগ করবেন তিনি বেশি লাভবান হবেন; অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে উল্লেখ; ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক; উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা; সাম্প্রদায়িকতাকে কৌশলে জিইয়ে রাখার চেষ্টা; ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করা ইত্যাদি।

এসব বিষয় ছাত্র সমাজ এবং সচেতন মহলকে দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এরই পরিণতিতে শিক্ষার দাবিতে ছাত্র সমাজের আন্দোলন ব্যাপক রূপলাভ করে এবং ১৭ সেপ্টেম্বরের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন আয়ুব সরকারকে বাধ্য করে ওই শিক্ষানীতি স্থগিত করতে।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর সব রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড , ছাত্র সংগঠনসহ সব ধরণের সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন  ও তৎপরতা বেআইনি করে সব ধরনের মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়। চলে চরম দমননীতি।

তৎকালীন দুই বৃহৎ ছাত্র সংগঠন-ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ এবং ডাকসু ও বিভিন্ন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সাধারণ ছাত্র সমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।

একদিকে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, অন্যদিকে চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল এবং গণমুখী শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভে দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

এই পটভূমিতে বিভিন্ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার দাবিতে ওই হরতাল সারাদেশে অভূতপূর্ব সাফল্য এবং ছাত্র জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আয়ুবের সামরিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।

তখন সাধারণভাবে যেকোনো ধরনের আন্দোলন এমনকি ছাত্র সমাজের যেকোনো তৎপরতার ওপর ছিল সামরিক সরকারের খগড়হস্ত। ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সূচিত আন্দোলন দমন করার জন্য গ্রেফতার, মামলা, হয়রানি, নির্যাতন, এমনকি বেত্রাঘাত সহ বর্বরোচিতভাবে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও হরতাল কর্মসূচি ঠেকানোর জন্য চরম নির্যাতনমূলক পথ গ্রহণ করা হয়। ওই দিন ঢাকাসহ দেশের সব শহরের রাজপথে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস প্রভৃতি তা দমন করতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল আব্দুল গণি রোড হয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ পেছনে থেকে অতর্কিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ওই দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহিদ হন। বহু ছাত্র-জনতা পুলিশ ও ইপিআর-এর নির্যাতন ও গুলিতে সারাদেশে আহত হন।

১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছাত্র আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ জনগণ ছাত্রসমাজের প্রতি আরও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। সারা দেশে তিন দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়।

২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে এক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের সমর্থিত ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়ে আয়ুবের সামরিক সরকার তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এবং একটি গণমুখী সার্বজনীন আধুনিক শিক্ষানীতির দাবিতে ঐতিহাসিক ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র আন্দোলন ও শহিদদের আত্মদান তথা শিক্ষার ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক ১৭ সেপ্টেম্বরকে সেদিন শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এরপর থেকে বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বহু উত্থান-পতনের মধ্যেও প্রতি বছর এই দিনটি ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছে। আজও শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষা দিবস’ অম্লান হয়ে আছে।

বাংলাদেশ সময় ২৩৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।