ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন: সমস্যা ও করণীয়

মো. সাবেত আলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন: সমস্যা ও করণীয় মো. সাবেত আলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না এমন বাক্য ছোট বেলা থেকেই আমরা বুঝে বা না বুঝে মুখস্থ করে এসেছি এবং এগুলো অতিশয় সত্য বাণীও বটে। আর এ মেরুদণ্ড যে কারখানায় তৈরি হয় তার নাম প্রাথমিক বিদ্যালয়।



একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায় নীতিবান, আদর্শবান,চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার উপর। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কি করা উচিত, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ এবং শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সমস্যা এবং তা উত্তরণে কিইবা করণীয় সে সব বিষয় নিয়ে আলোকপাত করাই এই লেখাটির মুখ্য উদ্দেশ্য।

এ লেখার পিছনে যে বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে তা হলো জাপানে দুই বছর অবস্থানকালে সেখানকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনামূলক মৌলিক পার্থক্য এবং মাঠ  প্রশাসনে  থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর বাস্তব অবস্থা।

আমরা জানি, এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিল খুব কম এবং মেয়েদের হার ছিল আরও কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন সময়মত বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্য বিবাহ রোধ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।

প্রশ্ন  হচ্ছে,  শিক্ষার হার বাড়লেই কি আদর্শবান জাতি হওয়া যায়? আমরা একজন শিক্ষিত মানুষের কাছে যে ধরনের ব্যবহার আশা করি, যে ধরনের সেবা প্রত্যাশা করি তা কি বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে সবসময় পাই? এর জবাব সবার জানা। যে ছেলেটি ৫ম কিংবা ৮ম শ্রেণি পাশ করে পিয়নের চাকরি নিয়ে বড়কর্তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে কি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নুন্যতম সৌজন্য বোধ শিখিয়েছে? কি ভাবে একজন সেবা প্রত্যাশী অপরিচিত মানুষকে সম্বোধন করতে হয়-তা কি শিখিয়েছে? তাকে কি শিখিয়েছে যে সে যখন বড় হয়ে সরকারি চাকরি নিয়ে অফিসে যাবে তখন জনগণের মালিক নয় সেবক হিসেবে ভাবতে হবে এবং সেবা দিতে হবে? আমার মনে হয় এসব প্রশ্নের অধিকাংশেরই জবাব হবে না বোধক। তাহলে এই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা দিয়ে আমরা কি আদর্শ বিনয়ী ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি করতে পারবো- আমার মনে হয় এটি দায়িত্বশীল সবাইকে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।

বাংলাদেশ সরকার এবং জাপান সরকারের বদান্যতায় আগস্ট ২০১১ হতে সেপ্টেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত সপরিবারে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে জাপানের টোকিওতে অবস্থান করার সুযোগ হয়েছিল। আমার মেয়ের বয়স তখন চার বছর, তাকে জাপানের একটি নার্সারি স্কুলে ভর্তি করলাম। যেখানে ৬ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের নার্সিং করা হয়। এরপর তাদেরকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করানো হয়। নার্সারি স্কুলে বাচ্চাদেরকে যা শেখানো হয় তা ছিল আমার কাছে কল্পনার মত। সেই  স্কুলের গল্প বলার আগে জাপান সম্পর্কে দুই একটি কথা না বললেই নয়। বিশ্বের  প্রায় ১৫টি দেশের মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে আমার । তাদের মধ্যে জাপানীদেরকে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি বিনয়ী জাতি মনে হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য মৌলিক মানবীয় গুনাবলি যেমন: সততা, কর্তব্য পরায়ণতা, কাজের প্রতি আন্তরিকতা,প রোপকারিতা, সেবা প্রদানে আন্তরিকতা,  দেশ প্রেম এগুলোতো আছেই।

আমার মনে প্রায় প্রশ্ন দেখা দিত, জাপানীরা এত বিনয়ী এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী হলো কিভাবে। আমি এই  প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেয়েছি যখন আমার মেয়েকে দুই বছর জাপানী নার্সারি স্কুলে পড়ালাম। আমি লক্ষ্য করলাম, নার্সারি স্কুলে প্রথম ছয় বছর বাবাদেরকে Alphabet আর কিছু সংখ্যাগত ধারণা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের তেমন কিছুই পড়ানো হয় না, এমনকি নির্ধারিত সিলেবাস বা কোন পাঠ্য বই নিয়েও স্কুল যেতে হয় না। সেখানে  শিক্ষকরা বাবা মায়ের স্নেহমমতা দিয়ে যা শেখান তা হলো আদর্শ-নীতি  নৈতিকতা, সততা এবং দায়িত্ব বোধ। উদাহারণ স্বরুপ- কিভাবে খেতে হয়, খাওয়ার আগে ও পরে কি বলতে হয়, বন্ধুর সাথে-শিক্ষকের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়, রাস্তা পারাপারে কি করণীয়, ফোনে কি ভাবে কথা বলতে হয়, মানুষের বিপদে কি ভাবে সাহায্য করতে হয়, পশু পাখি, ফুল ও গাছপালার সাথে কি ভাবে আচরণ করতে হয়, বাস, ট্রেনে চলাচলের সময় কিভাবে থাকতে হয়,  এসব বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয়ভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। এই বিষয়গুলো বলতে বলতে শিশুদের মনমগোজে এমনভাবে গেথে দেয়া হয় যে, বড় হয়ে তারা একদিকে যেমন বিনয়ী হয়, অন্য দিকে তারা হয়ে উঠে নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন আদর্শ মানুষ।
 
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের কমবেশী সবারই জানা আছে। জাপানের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার সাথে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো আমরা শুরুতেই বাচ্চাদের ঘাড়ে এক বোঝা বইয়ের ব্যাগ চাপিয়ে ভালো রেজাল্ট এর জন্য শিক্ষক অভিভাবক সবাই ছুটাছুটি করি। ফলে ভালো রেজাল্টধারী অনেক ছাত্র/ছাত্রী পাওয়া গেলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ভাল মানুষের বড়ই অভাব। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এই অবস্থার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল।

(ক) নৈতিক শিক্ষার অভাব:
প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের সিলেবাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে নৈতিক শিক্ষা বা নীতি কথার চেয়ে তাত্ত্বিক কথা অনেক বেশী যা বাচ্চারা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশের জন্য। আবার পরক্ষণে তা  ভুলেও যায়। আচরণগত শিক্ষা দেয়া হয় খুবই কম, এমনকি প্রতিদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে যে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয় তার অর্থ হৃদয় দিয়ে কতজন ছাত্র ছাত্রী অনুভব করে তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।

(খ) মান সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব 
বলতে দ্বিধা নেই, যারা মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের অনেকেরই নৈতিক মান নিয়ে অনেক খবর পত্র পত্রিকায় দেখা যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানোর মহান দায়িত্ব যাদের তারা শিক্ষকতা নামক মহান পেশাটিকে নেহায়েতই আয় রোজগারের একটি উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বা নিয়েছেন। এ অবস্থায় থেকে বের হওয়া খুবই জরুরী ।

(গ) শিক্ষকের অপ্রতুলতা 
বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকের যে অনুপাত তা মানসম্মত শিক্ষার জন্য মোটেও উপযোগী নয়। প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এ অনুপাত ১:৫৩। এই অনুপাত কমিয়ে ১:২৫ এ আনা উচিত। অন্যথায় শিক্ষার আদর্শিক গুণগত মানে পৌছানো কখনোই সম্ভব হবেনা।

(ঘ) শিক্ষার পরিবেশের অভাব
আদর্শবান জাতি গঠনের লক্ষ্যে সুস্থমেধা বিকাশ উপযোগী যে ধরনের শ্রেণি কক্ষ দরকার তা অনেক বিদ্যালয়েই অনুপস্থিত। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক বিদ্যালয়ে বসার বেঞ্চ নেই,  টয়লেট নেই, খেলার সামগ্রী নেই। যা প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে অত্যন্ত জরুরি।

(ঙ) দারিদ্র
বাংলাদেশে এখনও অনেক পরিবার দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে। এসব পরিবারের মা-বাবারা মনে করেন তার সন্তান স্কুলে গিয়ে যে বৃত্তি পাবেন তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে পারবে বাসাবাড়ী বা বাইরে অন্য কথাও কাজ করে। ফলে তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ের চেয়ে জীবন জীবিকার কাজে নিয়োজিত করতেই বেশি পছন্দ করে। শিক্ষার সুদুর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে তাদের ধারণাও একবারেই কম।

(চ) ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বলতা
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি অন্যতম দায়িত্ব হলো শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসএমসির অনেক সদস্যই শিক্ষার গুরুত্ব বা গুনগত মান বৃদ্ধির বিষয়ে মোটেও সচেতন নয় । অনেকেই এসএমসির সদস্য হওয়াকে বা সভাপতি হওয়ার বিষয়টিকে সন্মান বৃদ্ধির/ক্ষমতা-আধিপত্য বৃদ্ধির/আয় রোজগার বৃদ্ধির উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শকে বিবেচনায় না এনে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদানকে বিবেচনা করার জন্য বাধ্যতা মূলক করা যেতে পারে ।

(ছ) অভিভাবকদের অসচেতনতা
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু গ্রামে বসবাস করে এবং তারা কৃষি কাজে জড়িত, স্বাভাবিক ভাবেই তারা তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তাদের মত কৃষক বানাতে চায়। তাদের অনেকের ধারণা, পড়ালেখা করে গরীব মানুষের সন্তানদের চাকরি পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদুর প্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার মত কল্পনা শক্তিও তাদের নেই।

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয়:
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে যে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরা হল:

ক) শুধু সিলেবাসভুক্ত পড়াশুনা না করিয়ে আদর্শ ভিত্তিক নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।
খ) চার বছর বয়সে স্কুলে গমন বাধ্যতামূলক করে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শুধু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। ৬ বছর প্লাস হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান শুরু করতে হবে।
গ) শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী, চরিত্রবান ও যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে।
ঘ) শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো করে তাদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।
ঙ) ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে।
চ) শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের আরও বেশী সচেতন করতে হবে।
ছ) প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসে অন্তত ১ দিন একজন সফল ব্যক্তিত্বকে দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের কে ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য স্বপ্ন  দেখাতে হবে এবং জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।
জ) সর্বপরি, সুস্থ মেধা বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে।

পরিশেষে আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই যে, বিনয়ী, সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন একটি জাতি গঠনের জন্য যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা অচিরেই পূর্ণ হবে। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি গঠনে সবাই কাজ করব-এই প্রত্যাশা রইল সংশ্লিষ্ট সবার কাছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।