রুমা ও থানচি থেকে ফিরে: ১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা। স্থান বান্দরবানের রুমা উপজেলার যথুরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।
স্কুল এলাকা ছেড়ে পাশের পুনর্বাসনপাড়ায় দেখা মিললো বহু শিশুর। এ সব শিশু গ্রামের এক ফাঁকা জায়গায় জড়ো হয়ে খেলাধুলা করছে। স্কুলে না গিয়ে সবাই এখানে খেলা করছে। কারণ জানতে চাইলাম স্থানীয় বাসিন্দা অন্থুই মারমার কাছে। তিনি একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবকও।
অন্থুই মারমা বলেন, শিক্ষকেরা আসেন না। তাই, শিক্ষার্থীরাও স্কুলে যায় না।
শিক্ষকদের না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো শিক্ষকই এখানে থাকেন না। থাকার মতো জায়গাও এখানে নেই। স্কুলের তিনজন শিক্ষকের সবাই বান্দরবান শহরে থাকেন। বান্দরবান শহর থেকে রুমা সদর আসতেই লাগে কয়েক ঘণ্টা। রুমা সদর থেকে যথুরামপাড়া স্কুলে আসতে হয় সাঙ্গু নদী দিয়ে। স্পিডবোট দিয়ে এ নদী পার হয়ে স্কুলে আসতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা।
এই দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে কোনো শিক্ষকই এখানে প্রতিদিন আসতে চান না। আবার এই দূরগ্রামে শিক্ষকদের থাকা-খাওয়ার মতো কোনো জায়গাও নেই। তাই, শিক্ষকেরা বান্দরবান শহরেই থাকেন, যোগ করেন অন্থুই মারমা।
স্কুলের শিক্ষার্থী অথৈ মাও। অথৈই বললো, আজ তার স্কুল বন্ধ। কিন্তু, কেন বন্ধ, তা সে বলতে পারে না। অথৈয়ের কাছে থাকা বইয়ের কয়েকটি ছবি দেখিয়ে এগুলোর ইংরেজি ও বাংলা জানতে চাইলাম, কিন্তু সে এর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। এমনকি সে ভালো করে বাংলাও বলতে পারে না।
বাংলা বলতে পারা একজন অভিভাবককে দোভাষী হিসেবে কাজে লাগিয়ে ওর কথার অর্থ করা হলো।
মাসানু মারমা নামে দ্বিতীয় শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর কাছেও তার ক্লাসের পড়া জিজ্ঞাসা করলাম। তারও একই অবস্থা। এসব শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই বাংলা বলতে পারে না। অথচ এদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মারমা ভাষার জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলা ভাষা।
ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও যথুরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক স্কুল কমিটির সদস্য মংছেনু মারমা বলেন, সমতলে যেভাবে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে মনিটরিং করা হয়, দুর্গম বলে পার্বত্য জেলাগুলোতে ওই ধরনের নজরদারি করা হয় না। স্কুল পরিচালনা কমিটির নিয়মিত বৈঠকও হয় না।
তিনি বলেন, পুনবার্সনপাড়া থেকে রুমা সদর যেতে লাগে আড়াই ঘণ্টা। স্পিডবোটে ভাড়া দিতে হয় ১৫০ টাকা। এখান থেকে বান্দরবান সদরে যেতে লাগে আরো কয়েক ঘণ্টা। এতদূর থেকে এখানে আসা-যাওয়া কঠিন।
এ ছাড়া থানা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও এখানে নিয়মিত এসে শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করেন না। সে কারণে শতভাগ শিক্ষার্থীকে যেমন স্কুলগামী করা যাচ্ছে না, তেমনি যারা যাচ্ছেন তাদেরও ধরে রাখা যাচ্ছে না।
সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে সরকার শতভাগ শিশুকে স্কুলগামী করতে চায়। কিন্তু পার্বত্য জেলাগুলোতে দুর্গম যোগাযোগের কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এ বিষয়ে থানচি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মীর সুলতান আহাম্মদ বলেন, দুর্গম এলাকায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করা সত্যিই একটি দুরূহ কাজ। সরকার থেকে যে অর্থ দেওয়া হয়, তা দিয়ে তদারকি কাজ করা অসম্ভব। এজন্য অর্থ বাড়ালেও এসব এলাকায় পৌঁছানো কষ্টকর। তাই, পার্বত্য জেলাগুলোতে শতভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আবাসিক ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্র্যাকের এডুকেশন প্রোগ্রামের পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ওখানকার (পার্বত্য এলাকার) বাস্তবতার উপযোগী করে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে। ৩/৪ কক্ষের অবকাঠামো পাহাড়ি এলাকার জন্য উপযোগী নয়। উপযোগী অবকাঠামো প্রয়োজন। অবকাঠামোর পাশাপাশি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় কার্যক্রম চালু করতে হবে।
বিশেষ করে শিশুশ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কারণ, একটি শিশু মাতৃভাষায় যত সহজে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, ভিন্ন ভাষায় তা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করা গেলে ভালো হয়। আর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও আধুনিক শ্রেণিকক্ষ তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৪