ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

জাহাঙ্গীরনগরে যৌন নিপীড়ন

১০ বছরে ৫ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

ওয়ালিউল্লাহ, জাবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৫ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৫
১০ বছরে ৫ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ছবি : সংগৃহীত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ও নারী সহকর্মীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় গত ১০ বছরে ৫ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এদের মধ্যে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত ও দুই শিক্ষককে পদাবনতিসহ বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে।



খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহম্মেদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একই বিভাগের শিক্ষার্থীরা
ছাত্রীদের সঙ্গে অশ্লীল ও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ করেন।

এরপর ওই শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে ক্যাম্পাসে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে সিন্ডিকেটের ২৫৪তম সভায় তাকে অপসারণ করা হয়। ছাত্রী নিপীড়নের
অভিযোগে কোনো শিক্ষকের অপসারণের নজির জাবিতে এটাই প্রথম।

একই অভিযোগে ২০০৬ সালের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফার অপসারণের দাবিতে আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। ওই বছরের ১৬ নভেম্বর বাংলা বিভাগের এক ছাত্রী শিক্ষক ড. গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। পরে বাংলা বিভাগের আরও ৯ শিক্ষার্থী ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তোলেন।

ওই শিক্ষকের অপসারণ এবং যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রনয়নের দাবিতে তিনমাস নানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। এরপর সিন্ডিকেটে ২৬২তম সভায় ওই শিক্ষককে অপসারণ করা হয়।

২০০৮ সালের দিকে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন সভাপতি মো. সানোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন একই বিভাগের ছাত্রীরা। এ ঘটনায় দীর্ঘ আন্দোলনের পর প্রশাসন তদন্ত করে মো. সানোয়ার হোসেনকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপকে পদাবনতি দেয়। পাশাপাশি তাকে দুই বছর বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক মো. আবদুল্লাহ হেল কাফীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন ওই বিভাগের এক সহকর্মী। এ ঘটনায় যৌন নিপীড়ন বিরোধী তদন্ত সেলের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রশাসন তাকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপকে পদাবনতি দেয়।

২০১৩ সালে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক এ কে এম আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন তার বিভাগের ২২ ছাত্রী। যৌন নিপীড়ন বিরোধী তদন্ত সেলের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গত ২৯ মে জাবি প্রশাসন তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করে।

শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ও সহকর্মীদের যৌন হয়রানির এমন একাধিক ঘটনার কারণে বর্তমান প্রশাসন যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। জাবি’র বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নিজেও এক সময় যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধান ছিলেন।

বর্তমানে তার প্রশাসনই এ কে এম আনিসুজ্জামানকে যৌন নিপীড়নের দায়ে চাকরি থেকে অপসারণ করে। এছাড়া সম্প্রতি যৌন নিপীড়ন ও ছিনতাইয়ের দায়ে
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ৫ নেতা-কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কারও করা হয়।

তবে অধ্যাপক মো. মুনিরুজ্জামান এবং অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির উপাচার্য থাকাকালে জাবি শিক্ষক মো. সানোয়ার হোসেন এবং মো. আবদুল্লাহ হেল কাফীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাদের যথেষ্ট শাস্তি হয়নি বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

তাদের মতে, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পরও ক্ষমতাসীন হওয়ায় তাদের শুধু পদাবনতি ও বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। অথচ একই অপরাধে অপর তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এদের মধ্যে মো. সানোয়ার হোসেন সাজা ভোগ করে বিভাগে যোগ দিয়েছেন। পদোন্নতি নিয়ে তিনি বর্তমানে শিক্ষা ছুটিতে আছেন। মো. আবদুল্লাহ হেল কাফী
বিভাগে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হয়েছেন। বরখাস্ত হওয়া অন্য তিন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।

মো. আবদুল্লাহ হেল কাফীর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নারী সহকর্মী বর্তমানে কানাডায় শিক্ষা ছুটিতে আছেন। এ কে এম আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী
ছাত্রীরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন এবং পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়া অন্যান্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন।

এ বিষয়ে জাবি’র ইংরেজি বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থী মাহাদি আল হাসনাত বাংলানিউজকে বলেন, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দায়ী শিক্ষকদের শুধু বরখাস্ত এবং পদাবনতি দেওয়া হচ্ছে। যা পর্যাপ্ত নয়। চাকরি থেকে বরখাস্তের পাশাপাশি প্রচলিত আইনে এসব নিপীড়ক শিক্ষকদের শাস্তি হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাবি শাখার সভাপতি তন্ময় ধর বলেন, যৌন নিপীড়নের বিচারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর শাস্তির মাত্রা নির্ভর করছে। ফলে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হলেই স্থায়ী বরখাস্তসহ রাষ্ট্রীয় আইনে বিচারের দাবি অনেক আগে থেকেই করে আসছি আমরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক ক্ষমতাসীন দলের হলে পদাবনতি দেওয়া হচ্ছে।

একই ঘটনায় শিক্ষক বিরোধী দলের হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। ফলে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতার বলেন, সেলে এই মহূর্তে কোনো শিক্ষককের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নেই। যেগুলো ছিল আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছি। তদন্ত সেলের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রভাব না থাকায় স্বাধীনভাবে তদন্ত করা যাচ্ছে। ফলে আমরা কমিটির প্রায় সবাই যে কোনো বিষয়ে একমত হতে পারছি।

বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৫
আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।