ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: নয় লাখ টাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( ঢাবি) ‘ঘ’ ইউনিটে মেধা তালিকায় ৫ম স্থান অর্জন করার অভিযোগ উঠেছে এক ছাত্রী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে।
এই ছাত্রী ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ১৮ এবং ‘চ’ ইউনিটে ১২০ এর মধ্যে মাত্র ২৪ পেয়ে উভয় পরীক্ষায়ই ফেল করেছেন।
অথচ ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে ১০০ নম্বর পেয়ে কেবল উত্তীর্ণই হননি, মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান পেয়েছেন তাজরিন আহমেদ খান মেধা নামের এ ছাত্রী।
‘ক’ ইউনিট ও ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ের ব্যবধান মাত্র এক সপ্তাহ। অথচ দুটি পরীক্ষার ফলাফলে রয়েছে বড় মাপের তফাত।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে বড় অংকের অর্থ দিয়ে পরীক্ষায় জালিয়াতির সুযোগ নিয়ে এ ফলাফল অর্জন করেছে ছাত্রীটি। আর জালিয়াতি অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত একটি চক্রেরও সন্ধান মিলেছে।
চান্স পাইয়ে দেয়া বাবদ জালিয়াত চক্রকে নয় লাখ টাকা দেয়ার স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন অভিযুক্ত ছাত্রীর মা। মোবইল ফোনে সে নিয়ে কথপোকথনের রেকর্ড বাংলানিউজের কাছে রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য এবং বাংলানিউজের অনুসন্ধানে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি জালিয়াতির নানা তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অর্ণব চৌধুরী নামে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রের সঙ্গে নয় লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইয়ে দেয়ার চুক্তি হয় তাজরিন আহমেদ খান মেধার পরিবারের। চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই তাজরিনকে অনলাইনে প্রশ্নপত্র ও উত্তরমালা পাঠিয়ে দেন অর্ণব চৌধুরী। এরপর উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা কেন্দ্রে বৃত্ত ভরাট করে দিয়ে আসেন এ ছাত্রী। আর ফল প্রকাশের পর দেখা যায় শুধু চান্সই নয়; মেধাতালিকায় ৫ম অবস্থান অর্জন করেছেন জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া এই ছাত্রী।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অর্ণব চেধৈুরীর সঙ্গে একই রকম চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল তাজরিন আহমেদের আত্মীয় নিপু। একই উপায়ে জালিয়াতি করে ঢাবির ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৭৮ তম স্থান পেয়েছেন নিপু।
তবে চান্স পাওয়ার পর অর্ণবকে নিপুর পরিবার নয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে রাজি না হলে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। নিপুর পরিবার টাকা পরিশোধ না করায় তাজরিনের পরিবারকে অর্ণব চাপ দিতে থাকেন। কারণ নিপুর সঙ্গে তার যোগাযোগ তাজরিনের পরিবারের মাধ্যমেই হয়েছিলো।
এ বিষয়ে তাজরিন আহমেদের মা আইরিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের টাকা আমরা দিয়ে দিয়েছি। নিপুর পরিবার এখনো টাকা দেয়নি। আমরা মাধ্যম ছিলাম তাই ওরা ঢাকা থেকে আমাকেও টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। ’
জালিয়াতির কাজে জড়িত থাকা বিষয়ে জানতে চাইলে অর্নব চেীধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি এই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নই। তাজরীন ও নিপু নামের কাউকে চিনি না। তবে কথা বলার এক পর্যায়ে তাজরীন তার আত্মীয় (রিলেটিভ) বলে স্বীকার করেন অর্নব।
অর্নব চৌধুরীর ফেসবুক তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি একটা ভর্তি কোচিং এর সাথে সম্পৃক্ত। চান্স পাওয়ার পর অর্ণবকে তাজরিনের ট্রিট দেয়ার ছবিও বাংলানিউজের কাছে রয়েছে।
এর আগে ঢাবির আরো দুটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও উভয়টিতে অত্যন্ত খারাপ ভাবেই অকৃতকার্য হন তাজরিন। ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ১৮ নম্বর পান তিনি। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও ‘ক’ ইউনিটে রসায়নে পান (০) শূন্য নম্বর। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ৩০ মধ্যে পেয়েছেন ৩ দশমিক ৭৫। জীববিজ্ঞানেও একই অবস্থা। আর বাংলায় পেয়েছেন ১১ দশমিক ২৫।
আর ‘চ’ (রোল নং- ৫০২৭৭২) ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় সর্বমোট ১২০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন মাত্র ২৪ দশমিক ২৫ নম্বর।
তাজরিনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জানা যায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন ঢাবি ও জবির চারুকলায় কোন প্রিপারেশন ছাড়া টিকে গেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঢাবির ‘চ’ ইউনিটে তিনি অকৃতকার্য হয়েছেন।
এছাড়া তাজরিনের এসএসসিতে জিপিএ-৫ থাকলেও এইচএসসিতে ছিলো জিপিএ ছিলো ৪.৪২।
তবে ‘ঘ’ ইউনিটে (রোল নং-১৬৪০৬৯) তাজরিনের ফল অন্য সবগুলোর থেকে আলাদা। এই পরীক্ষায় তিনি বাংলা বিষয়ে ৩০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছেন ২৭। ইংরেজীতে পেয়েছেন ২৪, সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ বিষয়াবলী) বিষয়ে পেয়েছেন ২৪ দশমিক ৯০ এবং সাধারণ জ্ঞান (আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী) বিষয়ে পেয়েছেন ২৪ দশমিক ৩০ নম্বর।
ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াত অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তাজরিন বাংলানিউজকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘প্রশ্ন যে আউট করেছি আপনার কাছে ডকুমেন্ট আছে?
আগের দুটি ইউনিটে তার ফেল করার প্রসঙ্গ আনা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কোন্্ ইউনিটে ফেল করছি, কোন ইউনিটে পাস করছি তাতে আপনাদের মাথা ব্যাথার দরকার নাই। ’
এদিকে তাজরিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় মনোনয়ন পাওয়ার আগেই আইন বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলেও এ বিষয়টির প্রমাণ মেলে।
এমনকি ফেসবুকে অর্ণব চৌধুরীর ফেসবুক স্ট্যাটাসে বিজয় চিহ্ন সংবলিত মন্তব্যও করেছেন তাজরিন। এই স্ট্যাটাসে তার একজন বন্ধু মন্তব্য করেছেন- ‘কতটাকা লেগেছে?’
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, তাজরীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বেজোড় সিরিয়ালে ২ হাজার ২৯৭ তম হন। ‘ডি’ ইউনিটের পরীক্ষায় মাত্র ১৪ দশমিক ০৬ পেয়ে অকৃতকার্য হন। ‘জি’ ইউনিটেও ফেল করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখব। ১ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্ন যখন আমাদের কাছে ছিল সেখানে ফাঁস করার কোন সুযোগ নেই। কোন কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠানোর পর অসৎ লোক আছে যারা এই কাজ করতে পারে।
প্রসঙ্গত গত ২৮ অক্টোবর (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিনই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। পরীক্ষা শুরুর আগে ও পরীক্ষা চলাকালীন অনলাইনের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মেলে জালিয়াতির অভিযোগে আটক শিক্ষার্থীদের মোবাইল থেকে।
এদিকে ‘ডি’ ইউনিটের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় সামনের সারিতে থাকা অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা ভর্তিচ্ছুদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ বেশি। এমনকি বিজ্ঞান শাখার সেরা পাঁচ শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনজনই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আটক শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছিলেন বিজ্ঞান শাখার।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। আমরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার একটি চক্রকে আটক করেছি। জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ সময় ১৫০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
এসকেবি/এমএমকে