ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

প্রতিবন্ধিতাও নতজানু জেএসসি পরীক্ষার্থী মাসুদের কাছে!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৭
প্রতিবন্ধিতাও নতজানু জেএসসি পরীক্ষার্থী মাসুদের কাছে! পরীক্ষার হলে মেধাবী জেএসসি পরীক্ষার্থী মাসুদ। ছবি: বাংলানিউজ

দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) থেকে: ইচ্ছাশক্তি, সাহস আর প্রবল আত্মবিশ্বাসের জোরে শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে এগিয়ে চলেছে মাসুদুর রহমান। দু’হাতবিহীন এই মেধাবী শিক্ষার্থী এবারের জেএসসি পরীক্ষার্থী।

শারীরিক ত্রুটি বা অপূর্ণতার নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাও যেন আত্মবিশ্বাসী মাসুদের কাছে এসে নতজানু হয়েছে!

জন্ম থেকেই কনুইসহ এর পর থেকে দুই হাতের বেশিরভাগ অংশ না থাকা মাসুদ নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার চণ্ডিগড় ইউনিয়নের নাগেরগাতী গ্রামের হতদরিদ্র দিনমজুর সাহেব আলী ও হামেদা আক্তার দম্পতির ছেলে। উপজেলার নবারুণ উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্র গুজিরকোণা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, দু’হাত ছাড়াই দিব্যি অন্য পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে চলেছে মাসুদ। চিবুক ও না থাকা কনুই একত্রিত করে সেখানে কলম রেখে খাতায় লিখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষা শেষ করছে।

জেএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রটির সচিব ও গুজুরিকোণা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুধন চন্দ্র সরকারও বাংলানিউজকে বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে পরীক্ষার হলে মাসুদের জন্যে অতিরিক্ত বিশ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকে। কিন্তু কোনোদিন এ সুযোগ নেয়নি সে। অন্য পরীক্ষার্থীদের মতোই নির্দিষ্ট সময়ে খাতা জমা দিচ্ছে। অঙ্ক পরীক্ষায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি’।

‘মাসুদের আগ্রহ ও গতি আমাকেও মুগ্ধ করেছে। পরীক্ষার শুরু থেকে ওকে যতোই দেখছি, ভাবনার গহ্বরে ডুবে যাচ্ছি। মা-বাবা’র অর্থ নষ্ট করে উচ্ছন্নে যাওয়া ছাত্রদের জন্য মাসুম জীবন্ত দৃষ্টান্ত’।

শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে অত্যন্ত মেধাবী মাসুদ এলাকাবাসীর কাছেও সমান জনপ্রিয়। সরেজমিনে গেলে তারা জানান, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে নিজের সকল কাজকর্মও কারো কোনো সহযোগিতা ছাড়াই করে ছেলেটি।

মাসুদ বাংলানিউজকে জানায়, পড়ালেখা শেষে সরকারি চাকরি করে মা-বাবার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের ইচ্ছা তার। তবে কিঞ্চিত শঙ্কা রয়েছে মনে, অর্ধহাতের মানুষটিকে কোনো দফতরে চাকরি দেওয়া হবে কি-না?

পর মুহূর্তে সে শঙ্কাকে দূর করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মাসুদ, ‘শারীরিকভাবে একজন পরিপূর্ণ মানুষ যেমন নিজের কাজ বা দ্বায়িত্বগুলো পালন করেন, আমিও ঠিক তাই করি। সেক্ষেত্রে আমি পিছিয়ে থাকবো কেন?’

মাসুদের পড়াশোনার ঝোঁক তার হতদরিদ্র বাবা সাহেব আলীকেও অভিভূত ও উৎসাহিত করেছে। বাবার মন্তব্য, ‘কারো কোনো সহযোগিতা না পেলেও ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করতেও প্রস্তুত আছি’।

তবে অভাব আর দারিদ্র্যকে ছুঁড়ে ফেলে মাসুদের পড়াশোনা চলমান রাখতে সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বানদের এগিয়ে আসা ও সুদৃষ্টিও কামনা করেন তিনি।
 
মাসুদের মা হামেদা আক্তার বলেন, ‘জন্মের পর ছেলের হাত নেই দেখে অনেক কেঁদেছি। দিন যতো গড়িয়ে চলছিল, মাসুদকে নিয়ে দুশ্চিন্তাও বাড়ছিল। ভেবে ভেবে দু’চোখের পাতা এক করতে পারতাম না। তবে মাসুদ যখন বড় হয়ে কিছুটা বুঝতে শেখে, তখন থেকে কারো সহযোগিতা ছাড়া নিজের কাজকর্ম নিজেই করে! এটি দেখেই দুশ্চিন্তা কাটিয়ে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছি’।

নবারুণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অশোক কুমার ভাদুরী বলেন, আট সদস্যের পরিবারের অভাব-অনটন মোকাবেলা করে পড়ালেখা করছে মাসুদ। এলাকাবাসীর সঙ্গে শিক্ষকরাও এই ছাত্রটিকে নিয়ে গর্ববোধ করেন।

মাসুদের পরীক্ষা হলের দায়িত্বে থাকা কৃষ্ণচূড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জিন্নাত লাইলী বলেন, ‘কেউ আমাদের ছাত্র মাসুদকে প্রতিবন্ধী বলে ছোট করুক, আমরা তা চাই না’।

আর মাসুদকে নিয়ে মা-বাবাসহ পরিবারের প্রত্যেকের আশা, ছেলে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করবে। তাদের বিশ্বাস, সর্বোচ্চ শিক্ষা নেওয়া পর্যন্ত ভালোভাবে পাস করতে পারলে সরকার অবশ্যই মাসুদকে চাকরি দেবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।