এই উদ্যোগ প্রাণসঞ্চার করেছে দেশের হারিয়ে যেতে বসা, অবহেলায় পড়ে থাকা ভাষাগুলোর বিকাশের প্রক্রিয়া।
পাহাড় ও সমতলের ৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের হাতে এখন তাদের মাতৃভাষার বই।
চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর তিন ভাষাতেই বই ছাপিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০১৬ সালে শুধু প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া হলেও গেলো বছর মাতৃভাষায় বই পেয়েছে ১ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও। এখন থেকে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজিসহ অন্য বইয়ের সঙ্গে নিজ নিজ মায়ের ভাষায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
মায়ের ভাষায় পড়ার সুযোগ পাওয়ায় পাহাড়ের শিশুরা জড়তা কাটিয়ে বিদ্যালয়মুখী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন স্থানীয়রা।
পার্বত্য চুক্তি, শিশুনীতিসহ জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদ অনুযায়ী, মায়ের ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। সেই তাগিদে বর্তমান সরকার ২০১২ সালে প্রথম দফায় ৫টি মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় পর্যায়ে মাল্টি ল্যাংগুয়েল এডুকেশন (এমএলই) কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য তিনটি কমিটি গঠন করে।
প্রথম দফায় পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো- এই পাঁচ ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। ২য় পর্যায়ে বিঞ্চুপ্রিয়া, মণিপুরী (মৈতৈ), তঞ্চ্যঙ্গা, খাসি ও বম এবং তৃতীয়বারে কোচ, ওঁরাও, হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং; ভাষার পর একে একে দেশের অপরাপর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর কথা রয়েছে।
জানা যায়, খাগড়াছড়িতে চলতি বছর ৫৯২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকে চাকমা সম্প্রদায়ের ৫ হাজার ১শ ১২ জন ও ১ম শ্রেণিতে ৪ হাজার ২শ ৪৬ জন, প্রাক প্রাথমিকে মারমা সম্প্রদায়ের ২ হাজার ৮শ ৪৭ জন ও ১ম শ্রেণিতে ২ হাজার ৪৭ জন ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শিশুদের হাতে প্রাক প্রাথমিকে ৩হাজার ৫শ ৭৩ ও ১ম শ্রেণিতে ২ হাজার ৮শ ৯৮ জন শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষায় বই বিতরণ করা হয়।
এদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের হাতে হাতে বই পৌঁছে দেওয়া হলেও এ বিষয়ে নতুন কোনো শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এমনকি মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য দেওয়া হয়নি আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ। যে কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরা।
মহালছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মৌসুমী ত্রিপুরা ও দেবেন্দ্র মোহন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজিন্দ্র লাল ত্রিপুরা জানান, এখন থেকে পাহাড়ি শিশুরা মায়ের ভাষায় পড়তে পারবে। এতে শিশুরা এখন থেকে স্কুলমুখী হবে। ঝরে পড়া অনেকটা কমে যাবে। এখন শিশুদের নিজ নিজ মায়ের ভাষায় পড়ার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
ভাষা কমিটির অপর সদস্য ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপসহকারী মেডিকেল অফিসার ডা. অংক্যজাই মারমা বলেন, ধীরে ধীরে ভাষাগুলো মায়ের ভাষায় বই আকারে কোমলমতি শিশুদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এটি অনেক বড় পাওয়া। এখন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষেত্রে যদি চাহিদা অনুসারে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক থেকে থাকে, তাহলে তাদের ভাষার ভিত্তিতে পদায়ন করা জরুরি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘নিজ নিজ মাতৃভাষায় লেখা ও পড়ার দক্ষতাসম্পন্ন’ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, ‘ এরই মধ্যে শিক্ষকদের মাতৃভাষায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় মোট ৯০ জন শিক্ষককে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৫১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৮
এডি/এএ/জেএম