ঢাকা: ২০২০ সালের শুরুতে করোনা ভাইরাস ইউরোপ-আমেরিকাতে তাণ্ডব চালিয়ে স্তব্ধ করে দেয় শিক্ষা ব্যবস্থা। আর চলতি বছরের ৮ মার্চ প্রাণঘাতী করোনার প্রথম সূচনা ঘটে বাংলাদেশে।
উন্নত বিশ্বে ডিজিটাল উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ক্লাশরুম উইদ-আউট বর্ডার অর্থাৎ অনলাইন শিক্ষার তত্ত্ব চালু থাকলেও আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ব্যাপারে আগ্রহী হলেও এর সার্বিক সাফল্যের বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে বিলম্ব করতে থাকে। ইতোমধ্যে বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তথা সরকারি সিদ্ধান্তের আগেই অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দেয়। ঠিক সে সময়েই ইউজিসি এ কার্যক্রমের সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়নকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে প্রস্তাব আহ্বান করে। এর ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন ভার্চ্যুয়াল সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফম- জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট প্রভৃতি ডিজিটাল মাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে এ ক্ষেত্রে ইউজিসির আওতায় প্রাপ্য বিডিরেন এর সমন্বয় প্রভুত উপকারে এসেছে। তবে চ্যালেঞ্জ ছিল, কতটুকু ফলাবর্তন পাওয়া যাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। মফস্বলে সেটা ছিল আরও কঠিন। সব শিক্ষার্থীর কাছে ছিল না ডিভাইস। নিউ মিডিয়ার এসব সরঞ্জাম ব্যবহারে সমান পারদর্শীও নয় সবাই। কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কও সব জায়গায় সমান নয়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে মহামারিতেও শিক্ষা কার্যক্রম বেগবান রাখতে পেরেছেন বলে মনে করেন ফেনী ইউনিভার্সিটির উপাচার্য, বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহ। তার মতে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী গত দু'টি সেমিস্টারের ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। “সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও যেহেতু আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সব সময় ভার্চ্যুয়াল মিথস্ক্রিয়া ছিল তাই আমরা নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস- পরীক্ষা অনলাইনে নিতে পেরেছি। এক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনন্টেশন, শট কোয়েশন, ভিডিও ক্লিপস ও ভাইভা নেওয়া হয়েছে।
এটি একটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এখানে প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে; যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি।
শিক্ষার্থীরা তাদের সেমিস্টার ফি মোবাইল ব্যাংকিং তথা বিকাশ/রকেট প্রভৃতি অথবা সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করছেন। আমরা সামার সেমিস্টারের ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে সফল ভাবে সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে আমাদের ফল সেমিস্টারের ভর্তি কার্যক্রম চলমান আছে। ”
অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞার বর্ণনা করতে গিয়ে ফেনী ইউনিভার্সিটির প্রক্টর ও আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, “বর্তমান পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদেরও প্রযুক্তির শিক্ষায় দক্ষ হতে হবে। ফেনী ইউনিভার্সিটি একটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও করোনা সংকটকালীন সময়ে ভার্চ্যুয়াল ক্লাস-পরীক্ষায় এখানকার শিক্ষার্থীদের রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ করে সম্মানিত উপাচার্য মহোদয় অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। এর ফলে ইতোমধ্যে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দু’টো সেমিস্টার সম্পন্ন হয়েছে। ”
একই বিষয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়র লেকচারার আতাউল হাকিম মাহমুদ বলেন, ‘‘অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র। যেসব শিক্ষার্থী শহরে বা জেলা শহরে থাকে, উন্নত ব্রডব্যন্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা ভালো বুঝতে সক্ষম হয়, ক্লাসে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় গ্রামাঞ্চলে এমনকি শহরের অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়াটা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা অনলাইন ক্লাসকে প্রথম দিকে ভয় পেলেও পরবর্তীতে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ধীরে ধীরে প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন করে এটির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। অংশগ্রহণের হার নিয়মিত ক্লাসের চেয়েও বেশি হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। ”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা আবার ক্ষেত্রে বিশেষে ভিন্ন। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস শুরু করেনি। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও শিক্ষার্থীদের মনযোগের ওপর নির্ভর করেছে অনলাইনে পঠন-শিক্ষনের প্রক্রিয়া।
এ বিষয়ে ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাশেদা আক্তার টুম্পা বলেন, “শিক্ষকদের আন্তরিকতার কারণে আমরা অনলাইন ক্লাসে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা ও ভাইভাতে আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। ”
এছাড়া করোকালীন সময়ে ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রম - বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মিটিং, একাডেমিক কাউন্সিল মিটিং, সিন্ডিকেট মিটিংসহ সব ধরনের কার্যক্রম চলমান আছে। গত মাসে “দি রিজিওনাল রোল অব ফেনী ইউনিভার্সিটি ইন ক্যারিয়ার বিল্ডিং থ্রু টু গ্র্যাজুয়েশন অ্যান্ড বিয়ন্ড” শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রিন্সিপালসহ প্রায় তিন শতাধিক অতিথি অংশগ্রহণ করেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অফিস খোলা রাখা হয়েছে। করোনা সংকটকালীন সময়েও দেড়’শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও বোনাস নিয়মিত দেওয়া হয়েছে। তবে প্রথম চার মাস মাসিক বেতনের ৫০ শতাংশ ও বর্তমানে ৭০ শতাংশ হারে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২০
আরআইএস