ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

বিতর্ক নিয়েই বিদায় নিচ্ছেন রাবি উপাচার্য আব্দুস সোবহান

মঈন উদ্দিন, রাবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৮ ঘণ্টা, মে ৪, ২০২১
বিতর্ক নিয়েই বিদায় নিচ্ছেন রাবি উপাচার্য আব্দুস সোবহান রাবি উপাচার্য আব্দুস সোবহান

রাবি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের দায়িত্ব শেষ হচ্ছে আগামী ৬ মে। উপাচার্য পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুর্নীতির নানা অভিযোগে তাকে বারবার বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে নিজ মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে অবসরগ্রহণ, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিসহ বিস্তর অভিযোগ নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন তিনি।  

মেয়াদের শেষ সময়ে এসেও বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। সর্বশেষ রোববার (২ মে) বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স কমিটিতে অনিয়মের চেষ্টার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উপাচার্যের বাসভবন, প্রশাসনিক ভবন ও সিনেট ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। তাদের বাঁধার মুখে ফিন্যান্স কমিটির সভা স্থগিত হয়ে যায়।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ৭ মে রাবির উপাচার্য হিসেবে দ্বিতীয়বার নিয়োগ পান ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। সেই নিয়োগের চার বছর শেষ হচ্ছে আগামী ৬ মে। এর আগে ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই উপাচার্যের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তিনি সবচেয়ে বিতর্কিত হন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিতে জমা দেন শিক্ষকদের একাংশ। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তে নামে ইউজিসি। তদন্ত শেষে ২৫টি অভিযোগের প্রমাণ পায় ইউজিসি। পরে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ মোট ৭৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসির তদন্ত কমিটি। যেখানে ৩৬ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন এবং ৭০০ পৃষ্ঠার সংযোজনী প্রতিবেদন।

মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতে নিয়োগের আবেদন যোগ্যতা শিথিল
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ৪৭৫তম সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক নিয়োগ-নীতিমালা পরিবর্তন করেন। এতে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা কমানো হয়। আগের নীতিমালায় আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিলো সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি। আর গ্রেড পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০। একইসঙ্গে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাক্রম প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। কিন্তু সেই যোগ্যতা কমিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৩.২৫ এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে থাকার শর্তও তুলে দেওয়া হয়।

নিয়োগের যোগ্যতা শিথিলের পর উপাচার্যের কণ্যা সানজানা সোবহান ও জামাতা এটিএম শাহেদ পারভেজ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এর মধ্যে মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করা সানজানা নিয়োগ পান ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। আর শাহেদ নিয়োগ পান ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। মেয়ের মেধাক্রম ছিল ২১ এবং জামাতার ৬৭তম। আগের নীতিমালায় তারা নিয়োগের আবেদনই করতে পারতেন না।

পরিবর্তিত নীতিমালায় ‘কম যোগ্য’ শিক্ষক নিয়োগ
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন নিয়োগ যোগ্যতায় উপাচার্যের মেয়ে, জামাতাসহ ৪৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপাচার্যের কন্যা, জামাতাসহ অন্তত ৩৪ জন শিক্ষকেরই আগের নীতিমালায় আবেদন করারই যোগ্যতা ছিলো না। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে এই ৩৪ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের পরামর্শ দেওয়া হয়।

নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তনের পর ২০১৮ সালে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে ৪ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়। যাদের মধ্যে তিনজনের আগের নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করার যোগ্যতাই ছিলো না। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়োগ পাওয়া পাঁচ জনের মধ্যে চার জন, ইইই বিভাগের চার জনের মধ্যে একজনের আগের নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিলো না। এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ট্যুরিজম, পদার্থবিজ্ঞান, ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগ ও ফলিত গণিত বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকেরই পূর্বের নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিলো না।

রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য প্রদান ও অবসর গ্রহণ
অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালে ৭ মে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর একই বছরের ২১ জুন রাষ্ট্রপতিকে না জানিয়ে উপাচার্যের পদে থেকে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। আবার ওই দিনই তিনি বিভাগ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ফলে উপাচার্যের পদে সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতার ফারুককে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে ২৪ জুন রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের অনুমতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি ২৯ জুন অবসরে যাওয়ার অনুমতি আবেদন করেন। উপাচার্য পদে সাময়িক শূন্যতা পূরণে ‘রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই’ এক দিনের জন্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. আখতার ফারুককে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নিয়োগ দেন। যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের পরিপন্থী।

উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি
উপাচার্য আবদুস সোবহান ২০১৭ সালের মে মাসে দায়িত্ব নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ওঠেন। এ জন্য ২০১৩ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে তার নামে বরাদ্দ করা ডুপ্লেক্স বাড়িটি কাগজপত্রে ছেড়ে দিয়েছেন বলে দেখানো হলেও আসবাব রাখার জন্য প্রায় দেড় বছর দখলে রাখেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ি ভাড়ার আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৬ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০২১
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।