ঢাকা: শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানভিত্তিক সক্ষমতা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
বুধবার (১ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহ্বান জানান তিনি।
বঙ্গভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রাঙ্গণে আয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে অংশ নেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে তথ্য-প্রযুক্তিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় বিশ্বব্যাপী সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে সেভাবে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে। ’
গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট ও ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণার মানই মূল সূচক। ’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদা ও যোগ্যতা বিবেচনা করে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আমি আশা করব ঢাবি এ যাত্রাপথে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে। ’
শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান অর্জনের তাগিদ দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিযোগিতারও আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে। তাই একজন শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে হবে। ’
‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও কারিক্যুলাম নির্ধারণ ও পাঠ দানের ক্ষেত্রে বিশ্বমানের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। ’
শিক্ষার্থীদের পরিবার ও দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সক্ষমতা অর্জন করার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাবা-মা ও অভিভাবকরা অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। এছাড়া তাদের পেছনে দেশ ও জনগণের বিনিয়োগও যথেষ্ট। তাই শিক্ষার্থীদেরকে পবিবার, দেশ ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা ও জ্ঞানানুশীলনের পটভূমিতে ১৯২১ সালে ঢাবি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে ব্যক্তিমনের সমন্বয় ঘটানোই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ’
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ঢাবি মুক্তবুদ্ধিচর্চা কেন্দ্র উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ বছরের গৌরবময় ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব-বাংলায় মুসলিম নেতাদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও জন্মলগ্ন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অসাম্প্রদায়িক ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের এক গৌরবময় বিদ্যাপীঠ। সূচনালগ্ন থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে মুক্তবুদ্ধিচর্চা শুরু হয়। ’
তিনি বলেন, ‘প্রথম বিশ্বযু্দ্ধের পর হতে উপমহাদেশে স্বাধীনতাকামী মানুষের উদারনৈতিক মুক্তচেতনানির্ভর ও সামষ্টিক জ্ঞানানুশীলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ঢাবি। ফলে ঔপনিবেশিক মানসিকতামুক্ত নতুন শ্রেণি সৃষ্টির পথও প্রশস্ত হয়। আর সেই পথ ধরেই এই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামেরও সূতিকাগার হয়ে উঠেছিল। ’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার প্রথম ২০ বছরের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এ সময়ে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে আবিষ্কার করেন ‘বোস-আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব’; অন্যদিকে বহুভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমাণ করেন যে, বাংলা ভাষার উৎসস্থল গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষায়, যেটি ছিল বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অবদান। ’
বাংলাদেশ সৃষ্টির সংগ্রামে ঢাবির অবদানের কথা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে অস্থিরতা ও মন্দা এবং বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির ঘটনা ঢাবির যাত্রাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে ঢাবির সঙ্গে সরকারের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক টানাপড়েন শুরু হয়। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ’
তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবিতে ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ঐতিহাসিক এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ঢাবির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবিতে ঢাবির শিক্ষার্থীরা জীবন উৎসর্গ করেন। এ আন্দোলনকে উপজীব্য করেই গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। বিশ্বের সব জাতিসত্তার ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণে ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। ’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ঢাবি পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঢাবির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইয়ুব খান সরকার ১৯৬১ সালে ‘ঢাবি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে, যা ‘কালা কানুন’ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন এবং ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩’ জারি করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত হয়। ’
‘বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বেকার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও ঢাবি সব অগণতান্ত্রিক, অপসংস্কৃতি এবং সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। এরই স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১৭ সালে ঢাবিকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। ’
মুজিব জন্মশতবর্ষে ঢাবিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি’ স্থাপনও একটি অনন্য উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেন আবদুল হামিদ।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী শহীদুল্লাহ, ঢাবির উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান, ঢাবির অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আজাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২১
এমইউএম/এসকেবি/এএটি