ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বাকৃবি কৃষি জাদুঘরের বিরল সংগ্রহশালা

মো.আশরাফুল আলম, বাকৃবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৩
বাকৃবি কৃষি জাদুঘরের বিরল সংগ্রহশালা

ঢাকা: কৃষি আদি সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি উপকরণ, প্রক্রিয়া পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও উদ্ভাবনে পাল্টে গেছে কৃষির ঐতিহ্য ও কৃষ্টি।

  প্রযুক্তির উৎকর্ষে এরই মধ্যে হারাতে বসেছে বিভিন্ন কৃষি উপকরণ। তাই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কৃষির ঐতিহ্য ও উপকরণ সংরক্ষণের সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)।

এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে দেশের একমাত্র কৃষিভিত্তিক জাদুঘর।

২০০২ সালের ১০ মার্চ দেশের প্রথম এই কৃষিভিত্তিক জাদুঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলেও কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কৃষি ঐতিহ্য ও উপকরণ সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৭ সালের ৩০ জুন বাকৃবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মোশাররফ হোসাইন মিঞার উদ্বোধনে এ জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ৬৩৫০ বর্গফুট আয়তনের দ্বিতল ভবনের প্রথম ধাপে একতলার নির্মাণ কাজের জন্য মোট ব্যয় হয় প্রায় ৪৪ লাখ টাকা।

২০০৭ সালে চালু হওয়া এই জাদুঘরে এখনো চলছে কৃষি সম্পর্কিত ঐতিহ্যের সংরক্ষণ কাজ। সীমিত পরিসরে হলেও এ জাদুঘরটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আবহমান গ্রাম বাংলার কৃষিজ সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত কৃষি কাজের নিদর্শন, বিশেষ করে- বাঁশ ও বেতের তৈরি টুকরি, ওচা, মাথলা, বাঁশের তৈরি বাঁকসহ ঝুড়ি, বাঁশের তৈরি টুরং, কুরুম, তেরা, খালই, গরুর ঠোয়া, বিভিন্ন ধরণের হুক্কা, বাঁশের তৈরি চালুন, কুলা, ডুলি, লাঙল, জোয়াল, মই, কোদাল, দা, নিড়ানি, কাস্তে, কাঠের তৈরি ঢেঁকি, পলো, চেং, বাইর, উড়ি, সানকি, বিজয়পুরের চীনা মাটি, এঁটেল মাটি, দুআঁশ মাটিসহ বিভিন্ন ধরনের মাটি, জীবাণু সারসহ বিভিন্ন ধরনের সার।

এছাড়া বাকৃবি, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন  কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধান, পাট, ডাল, ছোলা, সরিষা, টমেটো, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য বীজ, বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ, অপরাপর অনুষদ ভিত্তিক বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, সয়েল টেস্টিং কিট, ইনসেক্ট কালেক্টিং বক্স, বিবর্তনের ধারায় যান্ত্রিক কৃষি কাজের মডেল, পাহাড়ি চাষাবাদ পদ্ধতিসহ কৃষি কাজের বিভিন্ন মডেল।

রয়েছে অজগর সাপ, জাতিসাপসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর কঙ্কাল, মাটির তৈরি বাঘসহ গ্রাম বাংলার কৃষকদের ব্যবহৃত এবং বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন কৃষি উপকরণ। শুধু তাই নয়, যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে ব্যবহৃত নানা রকম প্রবাদ বাক্য, খনার বচন প্রভৃতিও স্থান পেয়েছে জাদুঘরটির দেয়ালে দেয়ালে।

জাদুঘরের একটি অংশে আদিবাসী গারো সম্পদায়ের বংশ ধারার বাহক নাতক, ক্রাম ও ডামা রয়েছে। তাদের মদ তৈরি উপকরণ গাছেক, রাউ, ফং, ঝান্ছি, দিক্কাও সেখানে স্থান পেয়েছে। আছে গারোদের বাদ্যযন্ত্র নাগ্রা, অলংমা, ওঠাকারু, সানাই ও মিল্লাম। দেশীয় ঐতিহ্যের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে একতারা, লাউয়া, বেহালা, দোতরা, তরই বাঁশের বাঁশিসহ লোহা ও অন্যান্য বাঁশের বাঁশি, হারমোনিয়াম ও শঙ্খ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে মাথার খুলিসহ মহিষ, বন ছাগল ও হরিণের শিং।

যাদুঘরটির বিশেষ আকর্ষণ, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে ব্যবহৃত প্রথম মাইক্রো কম্পিউটার। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে বাকৃবিতেই প্রথম মাইক্রো কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে কম্পিউটার জগতে প্রবেশ করে।

১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কোর্স অধ্যয়নের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ১৯৮১ সালে বাকৃবি’র প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রক্রিয়া কাজে সর্বপ্রথম এটি ব্যবহৃত হয়। মাইক্রো কম্পিউটারটি সঙ্গে ব্যবহৃত প্রিন্টারটিও এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও দেশে কৃষি শিক্ষায় সর্বপ্রথম ব্যবহৃত বিভিন্ন মডেলের কয়েকটি ক্যালকুলেটরও স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে।

কালের ধারায় কৃষির আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় নেতাদের ভূমিকাও কম নয়। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৩৮ সালের ১১ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার কৃষি শিক্ষার উন্নয়নে ঢাকায় কৃষি ইনস্টিটিউটের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা মিছিল ছাড়াও ১৯৯২ সালে ‘লাঙল যার জমি তার’ স্লোগান তুলেছিলেন।

জিয়াউর রহমান দেশে খাল খনন কর্মসূচিসহ কৃষিতে বিপ্লব আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। কৃষিবিদদের সর্বপ্রথম প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড মর্যাদা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে জাতীয় এই চার নেতার প্রতিকৃতি। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সব উপাচার্যের ছবিও স্থান পেয়েছে জাদুঘরটিতে। দেশের একমাত্র এ কৃষি জাদুঘরটি যেন হয়ে উঠেছে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তির বিরল সংগ্রহশালা।

কৃষি জাদুঘরটির পরিচালক অধ্যাপক কাজী শাহানারা আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, কৃষিই এদেশের কৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি বলেই বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবে অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে স্বীকৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাতীয় সহযোগিতা এলে এটি হতে পারে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। জাদুঘরটি ছুটির দিন ছাড়া সকাল নয়টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৩
এএ/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।