নুহাশ পল্লী থেকে ফিরে: সব কাজের কাজী এক গাছের নাম অলস্পাইস। তবে সব কাজ বলতে বোঝাচ্ছি শুধু রান্না বিষয়ক সব কাজ।
অলস্পাইস বাংলাদেশের অধিবাসী নয়। সে মূলত দক্ষিণ মেক্সিকো, সেন্ট্রাল আমেরিকার মতো অঞ্চলের অধিবাসী। তবে গাছটির গুণাগুণের কারণে এখন বিভিন্ন দেশে তার চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ না হলেও শখের বশে অনেকেই দেশের বাইরে থেকে এনে বাগানে, টবে বা বাড়ির আঙিনায় লাগিয়েছেন অলস্পাইস।
যেমনটি আপনি দেখতে পাবেন প্রকৃতিপ্রেমী প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের বসতি গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে। একটি অলস্পাইস গাছ সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
সম্প্রতি নিসর্গী মোকারম হোসেনের আমন্ত্রণে একদল নিসর্গী, উদ্ভিদবিদ, প্রকৃতিপ্রেমীর সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ হয় সেখানে। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক একটি ভিন্নধর্মী সংগঠন ‘তরুপল্লব’।
সেখানের অসংখ্য মশলা ও ওষুধি গাছের মধ্যে অলস্পাইসের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হয়। পরিচয় করিয়ে দেন হর্টিকালচারিস্ট এস এম কামরুজ্জামান। পরিচয় পেয়ে অনেকটা আরো জানার ইচ্ছে। অতঃপর মনের আনন্দে লিখতে বসা।
একটু ঘুরে আসা যাক মশলার রাজার ইতিহাস থেকে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস জ্যামাইকা দ্বীপে প্রথম অলস্পাইস গাছ খুঁজে পান।
অলস্পাইস শব্দের অর্থ সব রকম মশলা। অলস্পাইসের স্বাদ জায়ফল, লবঙ্গ ও দারুচিনি, এই তিনটির মতো - এমন ধারণা থেকে ১৬২১ সালে ইংরেজরা গাছটির এমন নামকরণ করে। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Pimenta dioica। এছাড়াও amaica pepper, pepper, myrtle pepper, pimenta, pimento, English pepper, newspice ইত্যাদি নামে তার পরিচিতি আছে।
অলস্পাইস গাছ লম্বায় ১০-১৮ মিটার পর্যন্ত হয়। এটি আকারে ও উচ্চতায় ছোট হতে পারে, আবার কখনো লম্বা এবং অনেক বড়ও হতে পারে। লম্বা আকারের অলস্পাইস গাছকে কফি চাষের ক্ষেত্রে শেডট্রি বা ছায়াবৃক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বাড়ির আঙিনায়, বাগানে, ছাদে বা গ্রিনহাউজে সাধারণ মাটিতেই অলস্পাইস লাগানো সম্ভব। ছোট আকারের গাছগুলো অত্যধিক শীতে মারা যায়। তবে বড় গাছগুলো বেশি সহনশীল। সেগুলোকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
মূলত পিমেন্টা ডাওইকা গাছের ফলকে বলা হয় অলস্পাইস। তবে পিমেন্টা ডাওইকা গাছটি নিজেই সবার কাছে অলস্পাইস গাছ হিসেবে পরিচিত। এর ফলকে কাঁচা ও সবুজ থাকা অবস্থায় তুলে রোদে শুকানো হয়। ভালোমতো শুকানোর পর তার রং হয় বাদামি। তারপর তা গুঁড়ো করে ব্যবহারোপযোগী করা হয়।
এছাড়া রান্নায় ব্যবহার করা হয় অলস্পাইসের পাতাও। এর ব্যবহার অনেকটা তেজপাতার মতো। ঘ্রাণ হওয়ার জন্য পাতাটি ব্যবহার করা হয় এবং খাবার পরিবেশন করার আগে তা তুলে ফেলা হয়।
তবে তেজপাতার মতো শুকিয়ে যাওয়ার পরেও এর ঘ্রাণ জোরালো থাকে না বলে এটাকে তাজা অবস্থায়ই ব্যবহার করতে হয়। একই কারণে বাণিজ্যিকভাবে এই পাতাকে বাজারজাতকরণ করা সম্ভব হয় না। অলস্পাইস থেকে তেলও তৈরি হয়।
মধ্য প্রাচ্য, ক্যারিবীয় ও প্যালেস্টিনিয়ান রন্ধনপ্রণালীতে অলস্পাইস খুব দরকারি একটি উপকরণ। আমেরিকায় এটি ডেজার্ট বা মিষ্টি জাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হয়। জার্মানিতেও রান্নার ক্ষেত্রে অলস্পাইস ব্যবহৃত হয়। ব্রিটেনে এর ব্যবহার অনেক বেশি।
কেকসহ বিভিন্ন খাবারে ব্রিটিশরা অলস্পাইস ব্যবহার করে থাকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে অলস্পাইস থেকে এক ধরনের মিষ্টি পানীয় তৈরি করা হয়। এছাড়া বার্বিকিউ সস ও সসেজ তৈরিতেও অলস্পাইস ব্যবহৃত হয়।
অলস্পাইস স্বাস্থ্যের জন্যও খুব উপকারী। এটি হজমক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অলস্পাইস থেকে তৈরি তেলের সঙ্গে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে নানা ধরনের ইনফেকশনের ওষুধ তৈরি করা সম্ভব।
এছাড়া দাঁতের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা যায়। অলস্পাইসে এক ধরনের তেল থাকে যার নাম ইউগেনোল। এই তেলটি এন্টিসেপ্টিক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া অলস্পাইসে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য দরকারি।
অলস্পাইস বহুমুখী গুণের অধিকারী একটি গাছ। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া গাছটির জন্য সবচেয়ে ভালো হলেও এটি প্রায় সব রকম আবহাওয়াতেই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে।
তাই বাংলাদেশে চাষের জন্য এটি প্রবল সম্ভবনাময় একটি গাছ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৩
এমএনএনকে/এএ/এমজেডআর