আলেকজান্ডার, রামগতি, লক্ষীপুর: এ্যাত্তো ঘরবাড়ি ভাঙ্গে। কেউ তো দেহার লাই আইয়ে না।
প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললেন রামগতির আলেকজান্ডার ইউনিয়নের লঞ্চঘাটের তরুণ ব্যবসায়ী মো. জামাল। ঘাটে ভাঙনের কিনারে থাকা জামালের দোকানটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
এর আগেও কয়েকবার ভেঙেছে। এমনকি এর আগে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, দোকান বন্ধ করে রাতে বাড়িতে ঘুমাতে গিয়ে ভোরে এসে দেখেছেন, দোকান নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
খুব ছোটবেলা থেকে ভাঙন দেখেই বেড়ে ওঠা জামালের কণ্ঠে প্রতিবাদের সুর। কথা বলতে গিয়ে সব ক্ষোভ যেন ঝরে পড়ে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। ক্ষোভ ঝরানো কন্ঠেই বলেন, এখানে নেতা আছেন অনেক। কাজ করার লোক নাই। ভোটের আগে নেতাদের দেখি। এরপর পাঁচ বছরেও আর তাদের দেখা নাই। ভোট আসবে। আবার দেখবো। ভাঙন প্রতিরোধে এ এলাকার মানুষ মিটিং-মিছিল করেছেন। একপক্ষ আবার তাদের প্রতিহত করতে নেমেছেন।
ভাঙনের তথ্য সংগ্রহে রামগতি-কমলনগরের যেখানেই যাই, একই অভিযোগ সবার মুখে। গত ৫-১০ বছরে এখানকার ভাঙন প্রতিরোধে রুটিন কাজ ছাড়া বিশেষ কোনো প্রকল্প বাস্তবায়তি হয়েছে বলে চোখে দেখা যায়নি।
এ কারণে ভাঙন নিয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে দাবি-দাওয়া না তুলে এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগে নানাভাবে চেষ্টা করছেন নিজেদের ভিটে-মাটি রক্ষায়। কারণ, তাদের শেষ সম্বল ভিটে-মাটিটুকুও এখন ঝুঁকির মুখে। আর কয়কেদিন পরে হয়তো অনেকের বাপ-দাদার শেষ চিহ্নটুকুও অতলে হারিয়ে যাবে।
এলাকার প্রবীণেরা বলেন, রামগতি-কমলনগর দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এ এলাকার উন্নয়নে সরকারের কোনো নজরদারি নেই।
ইলিশ উৎপাদনের পাশাপাশি এ এলাকা সয়াবিন চাষের জন্যও বিখ্যাত। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিনরে চাষ হয় এখানে। চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ঢেঁড়স উৎপাদতি হয়। এখানকার ধান, নারিকেল, সুপারি, মরিচ, বাদাম দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা সত্ত্বেও এ এলাকার প্রতি সব সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ এলাকাবাসী একেবারেই মানতে পারেন না।
এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ বাসিন্দারা বলেন, এ এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকলেও কারো কোনো নজরদারি নেই। নদী ভাঙন প্রতিরোধে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও রামগতি-কমলনগরে বিশেষ কোনো অর্থ বরাদ্দ হয় না। আমরা কোনো সাহায্য চাই না। সব সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে শুধু নদী ভাঙন রোধে বরাদ্দ দেওয়া হোক।
সরেজমিনে বাংলানিউজকে পেয়ে এলাকাবাসী বলেন, জাতীয় নেতা আ স ম আবদুর রব এ এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে। সে সময়ে তিনি নেদারল্যান্ড থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল এনেছিলেন ভাঙন প্রতিরোধের গবেষণা করতে। ওই সময় কিছু বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়। সে সময়ে ড্রেজিংয়ের জন্য ড্রেজার মেশিন আনা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকার কারণে ড্রেজার মেশিনের ব্যবহার করা যায়ন।
রামগতি-কমলনগরের বর্তমান সংসদ সদস্য আশরাফউদ্দিন নিজান এবার নিয়ে পর পর দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে নিজের দল চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকার পরও কোনো কাজ করেননি তিনি এ অভিযোগও করনে এলাকাবাসী।
ওই সময়ে ভাঙন প্রতিরোধ কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা মনে করতে পারেননি এলাকাবাসী। ২০০৮-২০১৩ মেয়াদেও তিনি কাজই করেননি বলে অভিযোগ করেন এলাকার বাসিন্দারা।
জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না হয়ে কিছু কাজ হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রব চৌধুরী ও বিকল্পধারার নেতা মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের উদ্যোগে। এসব কাজে আবার বাধাও এসেছে কোনো কোনো পক্ষ থেকে।
রব চৌধুরী গত বর্ষা মৌসুমের পরই মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধে ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। চর আলেকজান্ডারে রামগতি উপজেলা পরিষদের দক্ষিণ পাশে এবং বাজার সংলগ্ন পশ্চিম পাশে কিছু ড্রেজিং হয়।
সূত্র বলছে, বিকল্পধারার নেতা মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জিও ব্যাগ (বালু ভর্তি বস্তা) দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। তার এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেন অন্যপক্ষ। একদিকে এলাকার মানুষের নদী ভাঙন প্রতিরোধের দাবি, অন্যদিকে ভাঙন নিয়ে এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলে রাজনীতির খেলা।
রামগতি পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মাহবুবুল আলম লিটন বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার রাজনীতির প্রধান ইস্যুই হচ্ছে নদী ভাঙন। নির্বাচন এলে এটাকে পূঁজি করেই নেতারা নির্বাচন করেন। পরে আর তাদের এ সমস্যা সমাধানে মাথাব্যথা থাকে না। বরং স্থানীয় লোকজন উদ্যোগ নিলেও তাতে বাধা আসে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছেও ভাঙনের প্রকৃত কোনো তথ্য নেই।
চর আলেকজান্ডারে এলাকাবাসীর উদ্যোগে জিও ব্যাগ দিয়ে ক্রস বাঁধ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধে চেষ্টা করা হয়। উপজেলা কার্যালয় থেকে মৌলভীকান্দি র্পযন্ত এ বাঁধ দেওয়া হয়। পরিকল্পনা ছিল ১ হাজার ফুট বাঁধ দেওয়ার। কিন্তু মাত্র ৪০০ ফুট দেওয়ার পরই রাজনৈতিক চক্রান্তে এ পরিকল্পনা সমূলে ভেস্তে যায়।
ভাঙন প্রতিরোধের উদ্যোক্তারা বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করেন, এলাকাবাসীর উদ্যোগে এ পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়তি হতে না পারে, সেজন্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হস্তক্ষেপ আছে। অথচ এলাকার মানুষ নিতান্তই নিজেদের বাপ-দাদার ভিটে রক্ষায় আন্দোলনের পাশাপাশি ভাঙন প্রতিরোধের এ উদ্যোগ নেন। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতাদের ডেকেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
কমলনগরের ফলকন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ এন এম আশরাফউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবরে। নদী ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা করা হয়।
কিন্তু তাতেও আসে নানামুখী বাঁধা। ভাঙন রোধে এলাকাবাসী উদ্যোগ নিলেও রাজনৈতিক নেতাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, এলাকাবাসীর চেষ্টায় রামগতি-কমলনগরের ভাঙন প্রতিরোধে এক হাজার ৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এ এলাকার ভাঙন রোধে একে সবচেয়ে বড় প্রকল্প বলছেন এলাকাবাসী।
তিন ধাপে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। প্রথম ধাপে ১৮০ কোটি টাকা, দ্বিতীয় ধাপে ৪৬০ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ধাপে ৪৫৮ কোটি টাকা ভাঙন কবলিত এলাকার নদীতীর রক্ষায় ব্যয় হবে। এলাকাবাসীর পক্ষে আবদুল মালেক, সামসুল বাহার খন্দকার, মাহবুবুল আলম লিটন, মো. জাহাঙ্গীর ও মোয়াজ্জেম হোসেনের আবেদন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে যোগাযোগের ভিত্তিতে এ প্রকল্প অনুমোদিত হয়।
এলাকাবাসীর এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন লক্ষীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিজান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সাড়ে চার বছরে প্রধানমন্ত্রীকে এলাকায় নেওয়ার জন্য বহুবার উদ্যোগ নিয়েছি। ভাঙন রোধে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা-তদবির করেছি। আমি এলাকার মানুষের সমস্যার সমাধান চাই বলেই তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৩১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এএসআর/এসআরএস