ঘড়িলাল, দক্ষিণ বেদকাশী (কয়রা, খুলনা) ঘুরে এসে: এখানে চাষিদের শীতের সবজি তোলার ব্যস্ততা নেই। মাঠে নেই ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, শিম, লালশাক, পালং শাকের মতো কোনো সবজি।
কিষাণ বাড়িতে নেই নবান্নের সাজ সাজ রব। ক্ষেতে চোখে পড়ে না ধানকাটার ধুম। খোলা মাঠ, বাড়ির উঠোন, রাস্তার কিনারে কোথাও একগোছা ঘাসের উপস্থিতি নেই। ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির-বিন্দুর দর্শন এখানে ভাগ্যের ব্যাপার।
এ গল্প খুলনা বিভাগীয় সদর থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের। দেশের অন্যসব এলাকায় শীত মৌসুম আসার আগেই মাঠে মাঠে শীত-সবজি চাষের ধুম পড়ে। কিন্তু এসব এলাকার চাষিরা এ সময়ে হয়ে পড়েন কর্মহীন। অনেকে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান বাইরের শহরে। এলাকায় কোনো কাজ থাকে না।
দক্ষিণ বেদকাশী গ্রাম লাগোয় গ্রামের সবচেয়ে বড় হাট ঘড়িলাল। এখানে কথা হলো গোলখালী গ্রামের সুজাউদ্দিন, মাটিয়াভাঙার আবদুর রশিদ, পূর্ব ঘড়িলালের লোকমান খাঁ ছাড়াও অনেকের সঙ্গে। তাদের মুখে এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা শুনে আঁতকে উঠতে হয়।
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রলয় এ এলাকার সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য মানুষদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পারেনি।
স্থানীয় লোকজন জানালেন, দাম কম আর দ্রুত সিদ্ধ হয় বলে এ এলাকার মানুষ আতপ চালের ভাত খায়। জ্বালানি সংকট প্রকট বলে কম লাকড়ি দিয়ে রান্না শেষ করতেই এমন কৌশল। মিনিকেট চাল এ এলাকার হাটবাজারে খুব বিক্রি হতে দেখা যায় না। অনেক বাড়িতে শুধু নতুন অতিথি এলেই মিনিকেট চালের ভাত রান্না হয়।
ঘড়িলালে হাটের দিন সরেজমিনে দেখা যায়, এখানে স্থানীয় কৃষিপণ্য বলতে গেলে একেবারেই ওঠেনা। গোটা বাজার ঘুরে মাত্র একজনকে পাওয়া গেল যিনি বাড়ির গাছ ছয় আঁটি বরবটি বিক্রি করতে বাজারে এসেছিলেন। তাজা এ সবজি তাকে বিক্রি করে দিতে হলো পানির দরে। হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনেকেই জানালেন, বাড়িতে শীতের কোনো সবজি ফলানোর কোনো সুযোগ নেই। কোনো গাছই হয় না।
ঘড়িলাল হাটের রাস্তায় আলু, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা কলা, আখ, বাতাবিলেবু, বেগুন, বিয়ের বধূ অঙ্কন আলতা, ইংলিশ উকুননাশক চিরুনি, রেমি স্পট ক্রিম, বাড়িতে বানানো গ্যাসস্ট্রিকের ওষুধ, ক্রিমির বড়ি, বন থেকে আনা কেওড়া ফল ছাড়াও অনেক কিছুই পাওয়া যায়।
সপ্তাহান্তে হাটে এসে এই এলাকার মানুষ এগুলো কেনে। অধিক দামে কিনতে হয় শুকনো সবজি, পচন ধরা আলু, শুকিয়ে যাওয়া আখ, নেতিয়ে পড়া শাক, পেকে যাওয়া কাঁচা মরিচ ছাড়াও উচ্ছিষ্ট পণ্য।
হাটের দিন রাস্তার পাশে কিংবা কোনো ঘরের বারান্দায় গ্রাম্য ডাক্তাররা বসেন কিছু রোজগারের জন্য। এসব ডাক্তারদের অনেকে আবার নিজেরাই ওষুধ তৈরি করে। তারপরও এ হাটের ডাক্তারেরাই প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের শেষ ভরসা।
এ এলাকার গ্রামগঞ্জে শিশিরভেজা শীতের তাজা সবজি নেই, নেই ঘড়িলাল হাটেও। তারপরও তেল-নুন-মশলাপাতিসহ সপ্তাহের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য নিতে দূরদূরান্ত থেকে এ হাটে বহু মানুষ ভিড় করেন।
তিন কেজি চাল, দুই কেজি আলু, কিছু সবজি আর সামান্য তেল-নুন-মচির নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় এসব মানুষদের। বাড়িতে শিশুদের আবদারে কেউ আবার দু’এক খন্ড প্রায় শুকিয়ে যাওয়া আঁখ কিংবা স্থানীয় ময়রার দোকান থেকে কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়েছেন।
গোলখালীর বাসিন্দা সুজাউদ্দিন বলেন, লবণ পানিও নেই, মিঠা পানিও নেই। জঙ্গলে ডাকাতের ভয়। নদীতে যাওয়া নিষেধ। গাছপালা লাগাতে পারছি না। মাছ চাষও করতে পারিনা। জমিতে ধানও করা যায় না। এ অবস্থা থেকেই বোঝা যায় এ এলাকার মানুষ কেমন আছেন।
মাটিয়াভাঙার আবদুর রশিদ বলেন, কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো এখন বেকার। যারা কাজ করতে পারছে, তারা হয়তো কিছু কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যাদের কাজ করার সুযোগ নেই, তাদের চরম দুর্দিন যাচ্ছে।
সূত্র বলছে, সিডরের আগে এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছপালা ছিল। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে চোখে পড়তো বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। নারিকেল, সফেদা, আম, জাম, খেজুরের গাছ ছিল সারি সারি।
গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ছিল, আবাদ হতো সবজি। মাঠজুড়ে ছিল ফসল। সিডরে একদফা ক্ষতি হয়েছে। আর আইলা শেষ করেছে বাকিটা। লবণ পানির প্রভাবে এলাকার চেহারাই বদলে গেছে। দেশের অন্য কোনো এলাকা থেকে এ এলাকায় এলে মনে হবে, অন্য কোনো দেশে এসেছি।
এলাকায় আবার সবুজ ফিরিয়ে আনতে কৃষিসেচ সুবিধা বাড়ানোর দাবি স্থানীয়দের। তারা মতে, সেচের জন্য শ্যালো টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট কৃষকদের মাঠে ফিরিয়ে নিতে হবে। কৃষির আবাদ ফিরে এলে হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল সবই পালন করা যাবে। আবার সবুজ ফিরে আসবে। শিশিরভেজা ভোর ডাক দেবে হাতছানি দিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/আরআইএস