সঙ্গে থাকা বনকর্মী অভয় দিচ্ছেন, ‘সন্ধ্যার আগমুহূর্তে এদিকটাতে ওর বের হবার কথা। ’ নিঃশব্দের এই হাঁটার সঙ্গে চলেছে এদিক-ওদিক খোঁজার পালাও।
লাউয়াছড়ার প্রতিটি সন্ধ্যে, প্রতিটি রাত যেন নীরবে স্বাগত জানায় এ উড়ন্ত কাঠবিড়ালিকে। ভরপুর করে দেয় টিকে থাকার অদম্য যাত্রাপথের লম্ফ-ঝম্পে।
সন্ধ্যে নামার দুর্লভ কোনো মুহূর্তে হঠাৎ করেই হয়তোবা চোখে পড়তে পারে এ প্রাণিটি। রাতের নির্জন পরিবেশে চরে বেড়ানো আর খাবার সংগ্রহ তার জন্মগত অভ্যেস বলেই এরা সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়। এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফ দিয়ে বাতাসে ভেসে থাকা বিরল এ প্রাণীটির নাম ‘উড়ন্ত কাঠবিড়ালি’।
কেউ কেউ আবার ‘উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি’ বলে থাকেন। এর ইংরেজ নাম Hodgson's giant flying squirrel এবং বৈজ্ঞানিক নাম Petaurista magnificus। দেহের উপরিভাগে কালচে-বাদামি হতে উজ্জ্বল কমলা রঙের সৌন্দর্য ছড়ানো। দেহের নিম্নতল সাদাটে-ধূসর।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এটিকে মহাবিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত বন্যপ্রাণি গবেষক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, কাঠবিড়ালি আমাদের কাছে অতি পরিচিত থাকলেও উড়ন্ত কাঠবিড়ালি ততটা নয়। এই উড়ন্ত কাঠবিড়ালি চলাফেরা অন্য সাধারণের চেয়ে কিছুটা আলাদা এবং আকারে বড়। উড়ন্ত কাঠবিড়ালি নামে ডাকা হলেও চলাচলের সময় ওরা সত্যিকার অর্থে ওড়ে না। এদের উড়ন্ত বলা হলেও পাখি বা বাদুর যেভাবে উড়ে তা নয়। তারা ভেসে বেড়ায়।
তিনি আরো বলেন, এরা সাধারণ কাঠবিড়ালির চেয়ে বেশি দূরত্বে লাফিয়ে পাড়ি দিতে পারে। এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে যাওয়ার সময় অনেকক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। আর তা দেখে মনে হবে এরা আসলে উড়ে উড়েই চলাফেরা করে। বিশ্রামের সময় তাদের ওই শারীরিক প্যারাসুটটিকে চোখে দেখা যায় না। স্থিতিস্থাপকতার কারণে এ প্যারাসুটটি তাদের শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে দেড়শ’ থেকে দু’শ ফুট দূরত্বে লাফাতে পারে।
অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান আরো জানান, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি স্তন্যপায়ী ও নিশাচর প্রাণী। সন্ধ্যের দিকে তারা খাবারের খোঁজে আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়। আবার ভোর হওয়ার আগেই ফিরে আসে। ফলে সচরাচর এদের দেখা পাওয়া না। গাছের নানান ফলমূল, কচি কাণ্ড, কুড়ি, বীজ, অঙ্কুর, পাখির ডিম প্রভৃতি ওর খাদ্য তালিকায় রয়েছে। মার্চ-জুন এদের প্রজনন মৌসুম।
প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, সিলেটের লাউয়াছড়া ও রেমা কালেঙ্গায়, চট্টগ্রামের টেকনাফের বন, কাপ্তাই ও বান্দরবানে চিরসবুজ গহিন বনে এরা বিচরণ করে থেকে। ভারত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, নেপাল, কম্বডিয়া, থাইল্যান্ড, চায়না প্রভৃতি দেশের গহিন বনাঞ্চলে এদের বসবাস।
প্রাকৃতিক চির সবুজ বন যেহেতু কমে যাচ্ছে তাই তাদের অবস্থা খুব একটা ভাল এটা কখনোই বলা যাবে না। তবে বিপন্ন বন্যপরিবেশ ও খাদ্য সংকটের কারণে এদের গড় আয়ু এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান অধ্যাপক ড. মনিরুল।
বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৭
বিবিবি/এসএইচ