প্রজনন বাড়ায় খাদ্য অন্বেষণে দলছুট হয়ে অন্যত্র চলে চাচ্ছে হনুমানের দল। এছাড়াও বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রতি বছরই মারা যাচ্ছে অনেক হনুমান।
রোববার (১৮ জুন) সরেজমিনে কেশবপুরে গিয়ে দেখা গেছে, পৌর এলাকায় অবস্থানরত কালোমুখো হনুমানের আরো ২০টি নুতন অতিথি এসেছে। তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যেও মা হনুমান ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খাদ্য অন্বেষনে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষের সবজি ক্ষেত, গাছের ফলমুল খেয়ে কোনো রকম জীবন বাঁচাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অহরহ হনুমানকে নির্যাতন করছে। এভাবেই কাটছে তাদের দিন।
বাদাম, কলা আর পাউরুটি নিয়ে হাসপাতাল কোয়ার্টার এলাকায় গিয়ে ডাক দিতেই ছুঁটে এলো একদল হনুমান। এই দলে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ২০টি বড় হনুমান রয়েছে। তবে চলতি মাসেই এ দলে ছয়টি নতুন অতিথি এসেছে। এসব বাচ্চা হনুমানের বয়স এক মাস হয়নি, তবুও তারা শিখে গেছে মায়ের কোলে কিভাবে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরতে হয়। দেখা গেছে, ছোট্ট বাচ্চা বুকের সঙ্গে আটকে রয়েছে। আর মা হনুমান এক গাছ থেকে লাফ দিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য গাছে। সত্যিই এদের চলাফেরা আর বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো।
খাদ্য বিতরণের কাজে নিয়োজিত অস্থায়ী কর্মচারী আতিয়ার রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কুঠিবাড়ি শ্বশানে হনুমানের দুটি দল অবস্থান করছে। এদের মধ্যে ৪২টি নারী ও ৩টি পুরুষ হনুমান রয়েছে। আর সম্প্রতি তাদের কোলজুড়ে অন্তত ২০টি বাচ্চা এসেছে।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, কেশবপুর উপজেলা পরিষদ চত্বর, রামচন্দ্রপুর, ব্রক্ষকাঠি, পাইলট স্কুল এলাকা, মধ্যকুল, হাসপাতাল এলাকা, ভোগতি, নরেন্দ্রপুর, বালিয়াডাঙ্গা, মণিরামপুরের মুজগুনি, বাঙালিপুর, দুর্গাপুর, ফকির রাস্তা এলাকা মিলে চার শতাধিক কালোমুখো হনুমানের বসবাস।
এসব হনুমানের জন্য ‘জীব ও বৈচিত্র সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্পের আওয়তায় প্রতিদিন এক মণ কলা, খোসাসহ আড়াই কেজি বাদাম ও দুই কেজি পাউরুটি সরবরাহ করা হয়। বন বিভাগের টেন্ডারের মাধ্যমে মেসার্স আলমগীর হোসেন নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ খাদ্য সরবরাহ করছে। তবে এতো সংখ্যক হনুমানের বিপরীতে খাদ্য একেবারেই কম হওয়ায় শুধুমাত্র উপজেলা পরিষদ চত্বর, হাসপাতাল গেট ও কুঠিবাড়ি শ্বশানে অবস্থানরত হনুমানের মধ্যে এ খাদ্য বিতরণ করা হয়। তবে আশপাশ এলাকায় অবস্থানরত আরও দুই শতাধিক হনুমানের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে।
বন বিভাগের টেন্ডারে টানা দু’মেয়াদে যশোর বিকে রোড এলাকার মেসার্স আলমগীর হোসেন নামের প্রতিষ্ঠানটি খাদ্য সরবরাহের কাজ পেলেও তিনি যশোর ঝুমঝুমপুর এলাকার মিজান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে লভ্যাংশ নিয়ে তাকে সরবরাহের দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে মিজান নামের ওই ব্যক্তি বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে খাবার কম দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। যদিও, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুর রহমানের তদারকিতে বর্তমানে সঠিকভাবে খাবার বিতরণ হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
কেশবপুর উপজেলা বন সংরক্ষক মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এতো সংখ্যক হনুমানের তুলনায় খাদ্য অপ্রতুল। এছাড়াও খাদ্য বিতরণের চলমান প্রকল্পটি চলতি জুন মাসেই শেষ হবে। ফলে নতুন প্রকল্প গ্রহণের জন্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
ইউএনও বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি কেশবপুরে নতুন যোগদান করলেও হনুমানের খাদ্য সংকট সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হয়েছি, আগামী টেন্ডারের আগে খাদ্য বাড়ানোর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করবো। ’ এছাড়াও খাদ্য বন্টনের ব্যাপারে তিনি তদারকি করেন বলেও জানিয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এখন থেকে প্রায় ৪শ’ বছর আগে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের আমলে মাড়োয়াড়ি সম্প্রদায়ের লোকেরা সৌখিনতা বশত কেশবপুরের বনাঞ্চলে বিরল প্রজাতির এই কালোমুখ হনুমান এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে এর বংশ বিস্তারের মাধ্যমে কেশবপুরে বিস্তৃর্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান শুধুমাত্র কেশবপুর পৌর এলাকাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে চার শতাধিক হনুমান রয়েছে। এক সময়ে এ অঞ্চলে প্রচুর ফলদ ও বনজ বৃক্ষ থাকায় হনুমানের খাবারের কোনো অভাব ছিলোনা। পর্যায়ক্রমে ওইসব বনজ ও ফলদ বৃক্ষ উজাড় হয়ে যাওয়ায় হনুমানদের জীবনযাপন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তীব্র খাদ্যের অভাবও দেখা দেয়।
২০০৫ সালে হনুমানদের সংরক্ষণ ও সরকারিভাবে খাদ্যে সরবরাহের দাবিতে কেশবপুরের সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের মুখে সরকার টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে হনুমানদের খাদ্য হিসেবে কলা, বাদাম ও পাউরুটি সরবরাহ করে আসছে। তবে সেই খাদ্যের পরিমান চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। পাশাপাশি প্রতিবছর হনুমানের বংশ বিস্তারের কারনে এর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বরাদ্দকৃত খাবার তাদের জীবন নির্বাহের জন্য খুবই অপ্রতুল। যে কারণে এসব হনুমানরা প্রতিনিয়ত খাবারের অন্বেষনে ছুটে চলছে বিভিন্ন এলাকায়। হানা দিচ্ছে সাধারন মানুষের রান্না ঘর, দোকানপাট ও ফলজ গাছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৭
বিএস