ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

হাওরের বুকে অতিথি পাখিদের সাথে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৭
হাওরের বুকে অতিথি পাখিদের সাথে হাওরের বুকে অতিথি পাখি। ছবি: সংগৃহীত

হাওরাঞ্চল (কিশোরগঞ্জ) থেকে: হাওরের জল টুইটুম্বুর থৈ থৈ চেহারা এখন আর নেই। হেমন্তে পানি নেমে গিয়ে ভেসে উঠেছে ধূ ধূ প্রান্তর। মাঝে মাঝে খাল বা নদীর অংশ ছাড়া বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে জলভেজা ভাব। নৌ-পথে চলতে চলতে দুই পাশের সদ্য জেগে উঠা মাটিতে নতুন প্রাণের স্পর্শ জাগিয়ে উদ্ভিদ ও শৈবালের দেখা মিলছে।

বহুদূরের দিগন্তে ডানার রূপালি ঝিলিক দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক অতিথি পাখি। ‘প্যারি হাঁস আসা শুরু হইছে’, বললেন যান্ত্রিক নৌকার মাঝি খলিল মিয়া।

উষ্ণতা ও আশ্রয়ের খোঁজে আসছে দূরান্তের অতিথি পাখি

বালি হাঁস প্রজাতির অতিথি পাখিদের হাওরের স্থানীয় মানুষ ‘প্যারী হাঁস’ নামে ডাকে। মাঝি খলিল মিয়ার বাড়ি হাওরে। তিনি স্থানীয় ভাষায় পাখিদের খোঁজ-খবর জানান আমাদের। কোথায় কোথায় পাখিদের ঝাঁক দেখতে পাওয়া যাবে, সে সব তার মুখস্ত।

‘হাওরে অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে’, বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) কিশোরগঞ্জ শহরে পৌঁছেই খবরটি জানতে পারি। হাওরের তিন উপজেলা (ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম) নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানালেন, ‘এবার আগে-ভাগেই অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে বিশাল হাওরাঞ্চলের নানা স্পটে। ’

শুক্রবার (৩ নভেম্বর) সারাদিন হাওরের বুকে অতিথি পাখিদের সাথে থাকার জন্য ভোরে কিশোরগঞ্জ থেকে তাড়াইল হয়ে ভেসে যাই হাওরের পানিতে। ইটনার চৌগাঙ্গা, বর্শিকুড়া, জয়সিদ্ধি আর মিঠামইনের চারিগ্রাম হয়ে সন্ধ্যার আগে খলিল মিয়ার নৌকা আমাদেরকে করিমগঞ্জের চামড়াবন্দরে নামিয়ে দেবে। কুয়াশা মোড়া সকালের সোনা রোদ ভেঙে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলে হাওরের গভীরে।

জলমগ্ন হাওরে আসছে অতিথি পাখি।  ছবি: দ্বীন ইসলামরোদ স্পষ্ট হতেই দেখা যায় ছোট ছোট পাখির ঝাঁক। বিচিত্র তাদের কিচির-মিচির কুজন। খলিল মিয়া বললেন, ‘অহনই সব পক্ষী আসে নাই। ’ তার মতে, ভরা শীতে হাওরে এতো পাখি আসে যে, সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের শব্দে চারদিক গমগম করে। চৌগাঙ্গা গ্রাম পেরিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল একদল ল্যাঞ্জাহাঁস। গ্রামের অনেক দূরে পানি সরে গিয়ে একটি প্রান্তরের মতো খালি জায়গা তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও জমে আছে কিছু পানি। দেখা যাচ্ছে, কাঁটা জাতীয় কিছু গুল্ম। সেখানে দিব্যি খেলা করছে ল্যাঞ্জাহাঁসের দল। সংখ্যায় যদিও খুব বেশি নয়, তবু তাদের বাহারী ডানায় সকালের আলো অলৌকিক দ্যুতি ফুটাচ্ছে।      

‘শীতের পাখির অন্যতম আবাস হাওরকে প্রাণবৈচিত্র্যের ভাণ্ডারও বলা যায়।   বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী পাওয়া যায় এই হাওরে। হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি, ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি, ১৪১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ১০৭ প্রজাতির মাছ রয়েছে’ জানান উন্নয়ন কর্মী সারাফ নাওয়ার। চৌগাঙ্গা গ্রামের ঘাটে তার সঙ্গে দেখা। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। অনেক পাখি, কীট ও মাছের প্রজাতি লুপ্ত হচ্ছে। ’

চৌঙ্গাগা থেকে জয়সিদ্ধি গ্রামের পথে চারিদিকে বিশাল জলমগ্ন চরাচর। তবে বর্ষার মতো ভয়াল রূপ নেই হাওরে। পানি শান্ত। মূল জলপ্রবাহের বাইরে জলাজমি ভেসে উঠেছে। পথে হাওরের স্থানে স্থানে বিল-ঝিল-নালা-নদীতেও ঝাঁক ঝাঁক পাখির দেখা মিলল।  

জয়সিদ্ধি গ্রামে দুপুরের খাবার সেরে কথা বলি আশরাফ আলির সঙ্গে। স্কুল শিক্ষক আশরাফ জানান, ‘সবচেয়ে বেশি হাঁস দেখা যায় বড় হাওরে। একসঙ্গে এত হাঁস বসে থাকে যে, টেলিস্কোপ লাগিয়েও গোনা যায় না। এগুলোর মধ্যে উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, গাডওয়াল হাঁস, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, ফালকেট হাঁস, গিরিয়া হাঁস ও টিকি হাঁস অন্যতম। ’

গ্রামের চারপাশে বর্ষায় জল ঘিরে রাখা জায়গাটা এখন শুকনো। পানি চলে গেছে প্রায়-কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরের মূল জলপ্রবাহে। চরের মতো আকার নিয়েছে গ্রামের চারপাশ। সেখানে কাঁটা জঙ্গলা আর কয়েকটি হিজল গাছে এসে বসেছে একদল খয়রা চকাচকি। মনের আনন্দে চলছে তাদের উড়াউড়ি।

ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে ভৈরব পর্যন্ত সারি সারি হিজল-করচ শোভিত জলমগ্ন হাওর। ভৌগোলিকভাবে হাওর পড়েছে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটের অংশে। শুধু এখানেই নয়, সমগ্র হাওরেই পাখিদের মেলায় ভরপুর। পাখিদের কলকাকলি মুখরিত হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। জনমানবহীন খোলা প্রান্তরে ধানের ক্ষেত, ছোট জঙ্গল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিযায়ী পাখির ভিড়। আমরা চড়ুই, শালিক, ময়না, খঞ্জনা ইত্যাদি অনেক স্থানীয় পাখিও দেখতে পেলাম। কোথাও জলমগ্ন ঝোপে পাশাপাশি পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, বালিহাঁস, শঙ্খচিল, বিভিন্ন প্রজাতির বক, সারস, পাতি কুট, সরালি হাঁস, ডাহুক ইত্যাদিও রয়েছে।

জলমগ্ন হাওরে আসছে অতিথি পাখি।  ছবি: দ্বীন ইসলাম। আশরাফ আলি বললেন, ‘আগে শিকারীদের জন্য পাখিরা নিরাপদ ছিল না। এখন প্রশাসন শিকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। জনসচেতনতাও বেড়েছে। হাওরে পাখি এখন অনেক বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে। ’   

ইটনার জয়সিদ্ধি থেকে মিঠামইনের চারিগ্রামের মাঝে বিরাট হাওর। বন্যপ্রাণী, বিচিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্রের জন্য এই হাওর পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। যেতে যেতে চোখে পড়ে নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি। এক সময় হাওরে ২০০ প্রজাতিরও বেশি গাছগাছালি, লতা-গুল্ম ছিল। অনেকগুলোই এখন আর নেই। মাছ ও উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণের অভাবে বিপণ্ন হচ্ছে।

দেখতে পেলাম অতিথি পাখির দল মূলত লোকালয় থেকে খানিকটা দূরের অপেক্ষাকৃত খোলা, জলমগ্ন, বনানীময় নিরাপদ এলাকা বেছে নিচ্ছে তাদের সাময়িক বসতির জন্য। শব্দ করে যান্ত্রিক নৌকা চলে গেলে ভয়ে উড়াল দিয়ে সরে যাচ্ছে। কোথাও রোদে পিঠ দিয়ে তন্ময় বসে আছে কিংবা ঠোঁটে মাটি খুঁড়ে খুঁজছে কীট-পতঙ্গ-খাদ্য। অপার তাদের শরীরের গঠন, পালকে রঙের কারুকাজ, চোখে মায়াবী দৃষ্টি।

কি অসীম আনন্দে আকাশের পাখিরা মুক্তডানায় অনায়াসে উড়ে বেড়ায়। পৃথিবীময় তাদের উড়ার পরিধি। পাখিদের কাছে দেশ আর অঞ্চল সীমান্তরেখাহীন। উত্তরের তুষারাবৃত্ত এলাকা থেকে উড়ে উড়ে দিব্যি চলে এসেছে বাংলাদেশে, যে দেশের নামটি পর্যন্ত হয়ত পাখিদের মূল দেশের অনেক মানুষ জানে না। একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে, খাদ্য আর আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত কম-শীতল আবহাওয়ায় কয়েকটি দিন কাটিয়ে আবার দিব্যি চলে যায় হাজার হাজার মাইল দূরের স্বদেশে। পথে ফেলে আসে কত স্মৃতি! কত ঘটনা!

বিকালের মুখে ফিরতি পথে মনে হলো, ঘুমন্ত হাওর জেগে উঠেছে। নালা, জঙ্গলা, ডোবা থেকে ছোট্ট ছোট্ট পাখির দল আকাশে ভাসতে শুরু করেছে। ছোট্ট ছোট্ট দলগুলো তৈরি করছে বড় বড় ঝাঁক। দিগন্ত ঢেকে দিচ্ছে পাখিদের অফুরন্ত উড়াল। বিচিত্র কিচির-মিচির আর কল-কাকলীতে মুখর হয়ে যাচ্ছে সমস্ত চরাচর। কখনো নিচের জলে বিম্বিত হচ্ছে তাদের চলমান ছায়া। মনে হচ্ছে মায়ার বাঁধনে ঘিরে ফেলছে অতিথি পাখিরা সমগ্র পৃথিবীকেই।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।