কালের বিবর্তনে অব্যবহৃত হলেও হাওরাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মৎস্য সম্পদ দেশ- বিদেশে পাঠাতে গড়া রেলস্টেশনের প্লাটফর্মটি এখন বিস্মিত করে এলাকাবাসীকে। পরিত্যক্ত বরফকল ভবনও কৌতুহলী করে তোলে নতুন প্রজন্মকে।
কি পরিমাণ মাছ সরবরাহ হলে আলাদা প্লাটফর্ম আর বরফ ফ্যাক্টরি তৈরি করতে হয়! ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদবাক্যের স্বর্ণালী সে দিনগুলো স্মরণ করে কিশোরগঞ্জের প্রবীণেরা তাই বলছেন, দেশের রেলওয়ের ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত একটিই।
তারা জানান, হাওর থেকে এখন আর অতো বেশি মাছ সরবরাহ হয় না। যাওবা আসে, সেগুলোও লঞ্চে-নৌকায় ভৈরব-কিশোরগঞ্জে আনার পর বাসে-ট্রাকে পাঠানো হয় দেশের সব অঞ্চলে।
তারা জানান, ১৯৪৭-৪৮ সালের সে সময়টাতে মাছ প্রক্রিয়াজাত করে দূরান্তে পাঠাতে দরকার হয়ে পড়েছিল আইস ফ্যাক্টরির। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন থেকে সদ্য স্বাধীন দেশে সর্বত্র বিদ্যুৎ নেই, বরফকল হবে কিভাবে? সরবরাহ ও চাহিদা বেশি হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি জানানো হয় ঢাকার আজিমপুরের অধুনালুপ্ত বিখ্যাত বেবি আইসক্রিমের (এ নামে একটি এলাকা এখনও আজিমপুরে আছে) মালিক অবাঙালি হারুন পাঠানকে।
বিপুল লাভের সম্ভাবনা দেখে তিনি বিরাট ওই আইস ফ্যাক্টরিটি চালু করেন কুলিয়ারচর রেলস্টেশন ঘেঁষে। শত শত মানুষ সেই ফ্যাক্টরি আর শীতল বরফখণ্ড তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন অবাক চোখে।
‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন হাওরের মৎস্য সম্পদকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে জমজমাট কোলাহল আর উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় ছিল প্লাটফর্ম আর বরফকলটিকে ঘিরে। তারপর আস্তে আস্তে স্মৃতিতে পরিণত হয় সবকিছু’- বলছিলেন প্রবীণেরা।
তাদের মতে, ‘অতীতের মৎস্যগন্ধী দিনগুলোর কথা শুনলে রূপকথা বলে মনে করে আজকের প্রজন্ম। মাছের ওই বিপুল প্রাচুর্য্যকে বুঝতেও পারবে না তারা। ‘মাছের ভাণ্ডার’ নামে পরিচিত কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে কতো প্রজাতির কতো পরিমাণ মাছ ছিল- সেটি অবশ্য এখন কল্পনা করাও সম্ভব নয়’।
‘পরিমাণে যেমন কমছে, তেমনি হারাচ্ছে নানা প্রজাতির মাছও। বিভিন্ন স্বাদ-গন্ধের মাছের প্রাচুর্য্যময় দিনগুলো তাই ক্রমেই স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে’।
‘আমাদের শৈশবে মাছের আঁশটে গন্ধে সারা বাড়ি মৌ মৌ করতো। মাছ কিনে খেয়েছি বহু পরে। নদী-নালা, খাল-বিল, পগাড়, জলা, ডোবা থেকে মাছ ধরেই সারা বছর চালিয়েছি আমরা। এতো মাছ যে, খেয়ে শেষ করা সম্ভব হতো না। অতিরিক্ত মাছ পরে খেতে রৌদ্রে শুকিয়ে রাখা হতো’- বলেন কুলিয়ারচরের লক্ষীপুর গ্রামের বর্ষীয়াণ নূরুল হক।
অতীতের কথা বলতে গিয়ে তার চোখ দু’টি চক চক করছিল- ‘আমরা ডোবা-খালে খাঁচার মতো বাঁশের তৈরি মাছ ধরার ফাঁদ পেতে রেখেছি। তিন-চারদিন পর সেগুলো উঠিয়ে এনে ভেতরে প্রচুর কৈ, শিং, বাইম, গজার পেয়েছি’।
‘শীতে বা চৈত্র মাসে নদী-নালার পানি শুকিয়ে এলে গ্রামের মানুষ দলবদ্ধ হয়ে মাছ ধরতে গিয়েছি। থক থকে কাঁদার ভেতর থেকে হাতেনাতেই ধরেছি জিয়ল মাছ। মাছে মাছে ভরে যেতো পুরো গ্রামের প্রতিটি বাড়ি’।
অশীতিপর কামালউদ্দিনের সারা জীবন কেটেছে কিশোরগঞ্জ শহরের পুরান থানা এলাকায়। তার অভিজ্ঞতাও বেশ চমকপ্রদ- ‘বাজার থেকে আগে আমরা সের বা কেজি দরে মাছ কিনিনি। আকার দেখে দাম ধরে কিনে এনেছি। এখন ছোট ছোট ভাগে মাছ বিক্রি হতে দেখে বড় দুঃখ হয়। বড় আকারের মাছও বিশেষ একটা দেখি না’।
কিশোরগঞ্জের বড়বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হোসেন খানের বয়সও সত্তর পার হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই মাছের ব্যবসায় আছি। আগে কতো বড় বড় মাছ পেয়েছি। হাওর থেকে ২০/২৫ কেজির রুই, কাতল, শোল, পাঙাস, আইড় মাছ কিনে এনে শহরের বাজারে বিক্রি করেছি’।
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘এখন এসব মাছ আর পাওয়া যায় না। ফিসারির চাষের মাছ অতো বড় হয় না, মাছের কড়া গন্ধও থাকে না। স্বাদ হবে কেমন করে!’
‘চাষের স্বাদহীন মাছের যুগে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা ওই মাছগুলো এখন কেবল মহার্ঘ্যই নয়, বিলুপ্তও হয়ে গেছে। যা কিছু আছে, সেগুলোও স্থানীয় বাজার এড়িয়ে চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা বিদেশে’।
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৭
এমপি/এএসআর