স্থানীয় ফুল চাষিদের দাবি, প্রতিবছরের মতো এবারো আসন্ন বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে গদখালীর ফুল সারাদেশেই সুবাস ছড়াবে।
এদিকে পৌষ পেরিয়ে মাঘ মাসের শেষ হতে চললেও তীব্র শীতে গোলাপের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী গোলাপ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা।
এদিকে এ সুযোগে কিছু চাষি বাড়িয়েছেন গোলাপের দাম, আর কিছু পাইকার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ থেকে গোলাপ ফুল আমদানির অপচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছেন। এ ধরনের অপতৎপরতা রোধ না করা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের সাধারণ ফুল চাষিরা। স্থানীয় ফুলচাষিরা বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে ফুলের চাহিদা অনুযায়ী কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ফুল যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। আসছে ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত বরণ, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা কমপক্ষে ৬৫ থেকে ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছেন। এরমধ্যে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে গদখালীর ফুলহাটে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি মৌসুমে গদখালী এলাকায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কৃষক দুই হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ করেছেন। গদখালী এলাকার মাঠের যে প্রান্তে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। রঙ-বেরঙের ফুলের সমারোহে গদখালী এলাকায় এখন অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি দিচ্ছে। চাষিরা জানালেন, আসন্ন তিন দিবস (বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বসন্ত বরণ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) ঘিরে ফুল কেটে বাজারে নিয়ে আসা এবং পরিচর্যায় মহাব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
গদখালী এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠজুড়ে জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা ফুল দোল খাচ্ছে। এসব ফুল রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বগুড়া, খুলনাসহ সারাদেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা কিনে গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাজার ঘুরে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিপিস গোলাপ ১০ থেকে ১২ টাকা, রজনীগন্ধা প্রতিস্টিক ৩ থেকে ৪ টাকা, গ্লাডিওলাস প্রতিপিস রঙভেদে ৫ থেকে ১২ টাকা, জারবেরা ৬ থেকে ১০ টাকা ও গাঁদা ফুল প্রতি হাজার ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গদখালী ফুলচাষি সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বসন্ত বরণ ও মহান ভাষা দিবসকে সামনে রেখে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দিবসগুলোতে অন্তত ৬৫-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছেন চাষিরা। সে অনুযায়ী এরইমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ফুল ক্রেতারা গদখালী ফুল হাটে এসে ফুল কিনেছে। তবে শীতের কারণে গোলাপের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই খাতকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যেই একটি মহল মিথ্যা ঘোষণায় ভারত থেকে গোলাপ আমদানির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশীয় ফুলচাষিদের স্বার্থেই এ ধরনের আমদানি বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
স্থানীয় কৃষকদের একমাত্র পেশা ফুল চাষ: ১৯৯৫ সালের আগে এ অঞ্চলের যে কৃষকরা ধান কিংবা সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, এখন তারা পুরোপুরিই ফুল চাষের ওপর নির্ভরশীল। অন্য ফসলের তুলনায় ফুল চাষ লাভজনক হওয়ায় গদখালীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে অন্য কোনো ফসল চাষ হচ্ছে না।
ফুলের হাট গদখালী: স্থানীয় চাষিদের উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী নামক স্থানে গড়ে উঠেছে বিশাল একটি ফুলের হাট। এ হাটে প্রতিদিন সকালে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এইহাটে ফুলের বেচাকেনা জমে ওঠে, বেলা ১০টা পর্যন্ত চলে ফুল বেচাকেনা। দেশের একমাত্র পাইকারি ফুলের এ হাটে সারাদেশের ব্যবসায়ীরা ফুল কিনতে আসেন।
ফসলের তুলনায় অধিক লাভজনক ফুল চাষ: স্থানীয় ফুলচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য যেকোনো ধরনের ফসলের তুলনায় ফুল চাষ অধিক লাভজনক। স্থানীয় পুটপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে গোলাপ কিংবা গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করতে খরচ হয় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। এরপর চারা গাছে একবার ফুল ধরলে তা কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ফুল দেয়। এতে বছরে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা আয় আসে।
ফুল চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন কৃষক: ১৯৮৩ সালের দিকে স্থানীয় হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক ফুল চাষ শুরু করলে তাদের সাফল্য দেখে অনেকেই ফুল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একপর্যায়ে ১৯৯৫ সাল থেকে অধিকাংশ কৃষক ফুল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কৃষক আয়ের উৎস হিসেবে ফুল চাষকে বেছে নিয়েছেন। সরেজমিন এলাকা ঘুরে জানা যায়, যেসব কৃষক গত ১০ বছর আগে পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’মুঠো ভাত পর্যন্ত জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন, ফুল চাষের মাধ্যমে তারা এখন সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। প্রত্যেকেই পাকা বাড়ি করেছেন। ঘুচে গেছে সংসারের অভাব-অনটন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯
ইউজি/জেডএস