তবে কালো রঙে চামচের মতো ঠোঁটকেন্দ্রীক এই পাখিটি পৃথিবীজুড়ে আজ মহাবিপন্ন। বাসস্থান, খাদ্য এবং প্রজনন সংকটের কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে তাদের অস্তিত্ব।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এ পাখিটিকে পৃথিবীব্যাপী ‘মহাবিপন্ন’ বলে লাল-তালিকাভুক্ত করেছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ পাখিগুলো আমাদের দেশে শীত পরিযায়ী। তবে এরা পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত। শীত শেষে চামচঠোঁটো-বাটানগুলো চলে যায় উত্তরপূর্ব রাশিয়ার ‘কামচাটকা’ নামক স্থানে। সবাই সাইবেরিয়া হিসেবেই চিনে; কিন্তু আসলে সাইবেরিয়ার সেই জায়গাটি হলো তুন্দ্রা। অর্থাৎ যেখানে বরফ চলে যাওয়ার পরও কোনো গাছপালা হয় না। তবে ছোটছোট ঝোপঝাড় বা গুল্ম জন্মে থাকে। ’
চামচঠোঁটো-বাটানের কৃত্রিম প্রজনন সম্পর্কে ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘গ্রীষ্মে এরা ডিম পাড়ে। আমরা তো তাদের প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে তাদের ডিমগুলো কয়েকবার চুরি করে এনেছিলাম। আন্তর্জাতিকভাবে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ডিম সংগ্রহের মাধ্যমে তাদের প্রজাতিগুলো সংরক্ষণে। তারা চারটা ডিম পাড়ে; চারটার মধ্যে থেকে দু’টো সরিয়ে নিলে আরো দু’টো পাড়ে। দু’টো করে করে সবার কাছ থেকে ডিমগুলো সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তারপর ইনকিউবেটরে সেই ডিমগুলো রেখে ফুটিয়ে বাচ্চা বড় করে আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে কিছু সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রায় ৪০টার মতো ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ এর বাচ্চাকে বড় করে তারপর প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ’
তিনি আরো বলেন, ‘সাইবেরিয়ার ওই জায়গায় সহজে যাওয়া যায় না। অনেক দুর্গম এলাকা। এখানে কোনো প্রকার বসতি নেই; কোনো যানবাহনও চলাচল করে না। শুধু রাশিয়ার মিলিটারি ট্যাঙ্কগুলোতে চড়েই যেতে হয়। আর ওইখান থেকে চামচঠোঁটো-বাটানের ডিম চুরি করে আনা হয়েছিল। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ছিল এটি; গত দশ বছর ধরে এই কাজটি করা হয়েছে। এর ফলেই কিন্তু এদের সংখ্যা বর্তমানে কিছুটা বেশি দেখা যাচ্ছে। ’
পৃথিবীতে মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ পাখি টিকে আছে। ওরা কাদাপানি থেকে একেবারে ছোট ছোট কাকড়া খুঁজে নিয়ে খায়। এই কাঁকড়াগুলো অনেকটা পিঁপড়ার মতো। এই একটি খাবার ছাড়া বাকি খাবারের কথা আমাদের জানাও নেই। এই পাখিটির উপর পৃথিবীব্যাপী আমাদের গবেষণা চলছে বলে জানান পাখি গবেষক ইনাম আল হক।
আন্তর্জাতিক সার্ভে সম্পর্কে ইনাম আল হক বলেন, ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ পাখিটিকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম আমরা আন্তর্জাতিক সার্ভে করি ২০০৬ সালে। তখন জার্মানি এবং ইংল্যান্ড থেকে আসা ১৪ জন পাখি বিশেষজ্ঞসহ বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের গবেষণাকর্মীদের সমন্বয়ে আমরা একটি বড় পাখি গবেষণা টিম গঠন করেছিলাম। আমরা এই টিমে যুক্ত হয়ে বড় দু’টো নৌকা নিয়ে দেশের বিভিন্ন উপকূল ঘুরে ঘুরে প্রায় মাসব্যাপী এই পাখিটির উপর সার্ভে করেছিলাম। এর উদ্দেশ্য ছিল- পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন এই পাখিগুলো কোথায় আছে এটা নিশ্চিত করা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও খোঁজা হয়েছিল; সেখানে একটি ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ও পাওয়া যায়নি। তারপর মিয়ানমারে জরিপ করা হয়েছিল; সেখানেও শূন্য; কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু আসলেই মিয়ানমারেই বেশি; অল্প একটা জায়গায়। আমরা এই জায়গাটাকে আবিস্কার করেছি অনেক পরে; ২০০৯-২০১০ সালের জরিপে বোঝা গেল যে- আসলে মিয়ানমারেই সবচে বেশি এই পাখিটি আবাস। ‘মার্তাবান’ বলে একটা জায়গা আছে। এখানেই ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ পাখিটির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে জরিপ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা প্রতি বছর মিয়ানমারে গিয়ে এই পাখিটির উপর জরিপ করে থাকি। এছাড়াও আমরা প্রতি মাসে বাংলাদেশের সোনাদিয়া উপকূলে এই পাখিটির উপর পাখিশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এই জরিপের তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখি পাখির গবেষণা কাজের লক্ষ্যে। তবে প্রতি মাসে তো ওরা থাকে না। তারপরও একটি-দু’টো যদি থাকে। কারণ গ্রীষ্মে ওদের দু’একটা যায় না; আমাদের দেশে থেকে যায়। কিন্তু থাইল্যান্ডে দেখা গেছে- যে ওরা পরিজায়ন করে না। ’
যে পাখিটি পৃথিবী থেকে হঠাৎ করে কমে যায়, তার উপরই আমাদের গবেষণাগুলো চলতে থাকে পৃথিবীব্যাপী। কয়েক বছর আগে আমরা আমাদের দেশে শীত মৌসুমে এই পরিযায়ী ‘চামচঠোঁটো-বাটান’ এর সর্ব্বোচ্চ সংখ্যা পেয়েছিলাম ৪৫টি। এখন মাত্র ২০-২২টির উপর আর পাচ্ছি না বলে জানান পাখি বিজ্ঞানী ইনাম আল হক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৯
বিবিবি/জেডএস