স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদে তাদের পরে প্রজন্মকে জন্ম দিয়েছে তিলা ঘুঘু (Western Spotted Dove)। পর্যটননগরী শ্রীমঙ্গলের একটি আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনির একটি পাতাবাহার গাছে দুটো তিলা ঘুঘুর ছানা বেশ কয়েকদিন হলো ডিম থেকে জন্ম নিয়েছে।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, দুটো তিলা ঘুঘুর ছানা টবের বাসায় আপন মনে বসে আছে। শরীরে ছোট ছোট লোম উঠেছে। মা-পাখিটা বাসায় তখন নেই। অনেকগুলো টবের গাছপূর্ণ একটা লাল রঙের টবকে মা-ঘুঘুটা নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছে। দারুণ একটি পাখিবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে এখানে।
এই ফ্ল্যাটে থাকেন খায়রুল আলম খান। তার স্ত্রী নায়লা আক্তার আব্বাসী নূপুর ব্যালকনির এই ছোট বাগানের দেখাশোনা করেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হঠাৎ মা-ঘুঘুটা মুখে খাবার নিয়ে এসে ছানাদের পাশে বসলো। পাখিপ্রেমী নায়লা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, এর আগেও আমাদের এই গাছগাছালিপূর্ণ ব্যালকনিতে বুলবুলি পাখি ছানা দিয়েছিল। এবারই প্রথম ঘুঘু পাখির ছানা ফুটালো। আমার স্বামী ও দুই মেয়ে এ বিষয় নিয়ে খুবই আনন্দিত। এছাড়া প্রতিবেশীরাও পাখিগুলোকে কোনোভাবে বিরক্ত করছে না।
এ ঘুঘু পাখি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, প্রায় ২৫ দিন আগে ওরা দুটো ডিম দিয়েছিল। আর ছানা ফুটেছে এই এক সপ্তাহ হলো। আমরা নিরাপত্তার জন্য কাপড় টাঙিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যার পর ব্যালকনির আলো দ না। ছানাদের ক্ষতির কথা ভেবে ওই টবে আমরা পানি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। শিশুসহ অচেনা কেউ ঘুঘুর বাসার কাছাকাছি এলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এভাবেই চলছে আমাদের ঘুঘুর ছানাগুলোকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা।
নায়লা আক্তার বলেন, আগে তো দিন-রাত মা-পাখিটা বাসায় বসে ডিমে তা দিতো। তিন-চারদিন ধরে দেখছি, মা-পাখিটা সকাল ৭টা/৮টার দিকে উড়ে চলে যায়। বেশকিছু সময় পর পর খাবার সংগ্রহ করে এনে ছানাগুলোকে খাওয়ায়। সন্ধ্যায় মা-পাখিটা বাসায় এসে বসে যায়। আর সারারাত ওভাবেই থাকে। মাঝেমধ্যে পুরুষ ঘুঘুটাকেও বাসার আশেপাশে পাঁয়তারা করতে দেখা যায়।
বুলবুলি পাখিগুলো সুন্দর করে বাসা তৈরি করে। কিন্তু বুলবুলির তুলনায় ঘুঘু পাখিকে দেখলাম, ওরা এতো সুন্দর করে বাসা তৈরি করে না; যেনতেন একটা বাসা হলেই হলো বলেও যোগ করেন নায়লা।
ওষুধ ব্যবসায়ী প্রতিবেশী জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা পাখিগুলোর প্রতি নিরাপত্তার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। ওরা খুবই সেনসেটিভ (স্পর্শকাতর)। যেন কেউই পাখিগুলোকে হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা না করে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ বাংলানিউজকে বলেন, তিলা ঘুঘু আমাদের দেশের এমন একটি আবাসিক পাখি, যে পাখি সবসময় নিজেকে আড়াল করে বাসা তৈরি করে থাকে। ওর লাইফস্টাইলটাই এমন যে সে প্রজননের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করে থাকতে পছন্দ করে। যারা পাখি নিয়ে কাজ করেন তাদের অনেকেই ঘুঘু পাখির ডিম কিংবা ছানা দেখেননি। এমন একটা জায়গায় অতি গোপনে বাসা তৈরি করে ডিম দিয়ে ছানা ফুটিয়ে চলে যাবে যে আপনি বুঝতে পারবেন না।
জনসম্মুখে কখনোই তিলাঘুঘু ব্রিড (প্রজনন) করে না। এমনি পরিস্থিতিতে ফ্ল্যাটের ব্যালকনির একটি টককে তিলাঘুঘু দম্পতি কতটুকু নিরাপদ মনে করলে এভাবে ছানা তুলতে পারে তা শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এভাবে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে কোনো পাখি বাসা বানালে মালিকসহ ফ্ল্যাটে বসবাসতরদের উচিত এ পাখিগুলোর শতভাগ নিরাপত্তা দেওয়া বলেও জানান তিনি।
তিলাঘুঘুর বৈচিত্র্যময় প্রজনন সম্পর্কে আদনান আজাদ আসিফ বলেন, প্রজনন মৌসুমি পুরুষ তিলাঘুঘু পাখির মুখে নেস্টিং এলিমেন্টস (পাখির বাসা তৈরি উপাদান) স্ত্রী পাখিটাকে স্বাগত জানায়। স্ত্রী-পাখিটার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। পরে তারা জুটি বাঁধে এবং দু’জনের মধ্যে প্রজনন কার্য সম্পন্ন করে।
অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে, পুরুষ পাখিটা ঠোঁটে নেস্টিং এলিমেন্টস অর্থাৎ টুকরো ডালের অংশ ধরে রেখেই ব্রিডিং (প্রজনন কার্য) করে। পুরুষ তিলাঘুঘুটার ঠোঁটে নেস্টিং এলিমেন্টস রাখার মানেই হলো, স্ত্রী-পাখিটাকে সে বুঝতে সক্ষম হয় যে, আমি আমাদের সন্তানের জন্য বাসা বানিয়ে দেবো। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ওরা ওদের প্রজনন মৌসুমে যুগলবন্দি হয়।
তিলাঘুঘু আকারে আমাদের কবুতরের মতো। লাল চোখের এ পাখিটি আকৃতি প্রায় ১০ সেন্টিমিটার। দেহ হালকা বাদামি। কাচলে ডানায় লাল তিল থাকে বলে এর নাম তিলাঘুঘু।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৯ ঘণ্টা ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০
বিবিবি/এএটি