লক্ষ্মীপুর: দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্যবাহী ‘মহিষা দই’। মহিষের কাঁচা দুধের টক দই সুস্বাদু হওয়ায় লক্ষ্মীপুরে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথিদের আপ্যায়নে এ দইয়ের বিকল্প নেই।
বিশেষ করে জেলার উপকূলীয় এলাকা রামগতি এবং কমলনগর উপজেলার প্রায় সবগুলো অনুষ্ঠানে অতিথিদের পাতে তুলে দেওয়া হয় মহিষের দই।
স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় এ দই ‘মহিষা দই’ নামে পরিচিত।
জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় লক্ষ্মীপুরের এ মহিষা দই এখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বর্তমানে এর ব্যাপক চাহিদা বাড়লেও নানা কারণে কমেছে উৎপাদন।
উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন বাজারে এ দইয়ের রমরমা বাণিজ্য চলে। বিশেষ করে সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট, কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ, মুন্সিরহাট, মতিরহাট, করইতেলা, লরেন্স, হাজিরহাট, লুধুয়া, চৌধুরী বাজার, করুণানগর, রামগতির জমিদার হাট, আলেকজান্ডার, বিবিরহাট, রামগতি বাজার এলাকাসহ অন্তত ৪০টি হাটের শতাধিক দোকানে বিক্রি হচ্ছে মহিষের কাঁচা দই।
জানা গেছে, মহিষের কাঁচা দই তৈরিতে প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১২ টনের বেশি দুধ প্রয়োজন। জেলার মেঘনা নদীর মাঝে জেগে উঠা বিচ্ছিন্ন চরে ব্যাপক হারে মহিষের বাথান (পাল) রয়েছে। জেলার সদর উপজেলার চর রমনী মোহন, চর মেঘা, রায়পুর উপজেলার হাজীগঞ্জ, টুনির চর, চর গাসিয়া, রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহ, তেলিরচর, মৌলভীর চর, চর মুজাম, চর আলেকজান্ডার, চর বাদাম, কমলনগর উপজেলার চর কাকঁড়া, মাইজের চর, চর শামছুদ্দিন এলাকায় মহিষ পালন করা হয়। সেখান থেকেই দই তৈরির প্রধান উপকরণ দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, রামগতি উপজেলার বিভিন্ন দ্বীপ চরে ৬ হাজার ৩শ, কমলনগরে ৬ হাজার, সদর উপজেলায় ৫ হাজার ৭শ এবং রায়পুরে ১২শ সহ জেলায় মোট ২০ হাজার মহিষ রয়েছে।
তবে স্থানীয় কয়েকজন বাথান মালিকরা জানান, প্রকৃত পক্ষে সরকারি হিসেবের চেয়েও বেশি মহিষ পালন করা হয়।
মহিষের বাথানের মালিক হোসেন মিয়া, মোসলেহ উদ্দিন, কাদের মিয়া, নুরুল আমিন জানান, মেঘনার নদীর বিভিন্ন চরে তারা দেশীয় জাতের মহিষ পালন করেন। একেকটি মহিষ দৈনিক ৫ থেকে ৭ কেজি করে দুধ দেয়। সেগুলো দইয়ের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন তারা। প্রতি কেজি দুধের বর্তমান বাজার মূল্য ৫০-৬০ টাকা।
তারা আরও জানায়, গোয়ালেরা প্রতিদিন সকালে বিভিন্ন চরে গিয়ে মহিষের দুধ সংগ্রহ করেন। পরে সেগুলো ট্রলার যোগে নিয়ে এসে পৌঁছে দেন দধির দোকানগুলোতে।
মহিষের বাথানের মালিক ও জেলা পরিষদের সদস্য মেজবাহ উদ্দিন হেলাল বাংলানিউজকে বলেন, রামগতি উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্লাহতে তাদের পরিবারের প্রায় ২০০ মহিষ রয়েছে। কয়েক বছর আগে এর দ্বিগুণ মহিষ ছিল। সেখানকার শতাধিক মহিষ দুধ দেয়। দুধগুলো বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।
কমনগরের চর শামসুদ্দিন এলাকার মহিষ বাথানের মালিক ও দই বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, চরে আমার ১০০ মহিষ আছে। ৬০-৬৫ টি মহিষ থেকে দুধ সংগ্রহ করি। দুধ দিয়ে নিজেই দই তৈরি করি। সেগুলো পাইকারি এবং খুচরা বিক্রি করি।
দুই থেকে দই তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মহিষের কাঁচা দুধ থেকেই দই তৈরি করা হয়। দুধ সংগ্রহ করার পর প্রথমে পরিষ্কার মাটির হাঁড়িতে পরিমাণ মতো দুধ দিই। এরপর হাঁড়ির মুখে কাগজ দিয়ে বেশ কয়েকটি চটের বস্তা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখি। টানা ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বস্তার নিচে চাপা থাকে, এতে কোনো বাতাস বের হতে বা ঢুকতে পারে না। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুধ জমাট বেধে কাঁচা দইয়ে পরিণত হয়। প্রতিকেজি দুধ থেকে প্রায় ৯০০ গ্রাম দই তৈরি হয়।
তিনি আরও জানান, সাধারণত এসব দই বসানোর সময় দুধের সঙ্গে চিনি মেশানো হয় না। তবে পরিবেশনের সময় দইয়ের সঙ্গে চিনি বা মিষ্টি দেওয়া হয়। প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে ২ মণ দই বিক্রি করেন তিনি।
কমলনগরের তোরাবগঞ্জ বাজারের দই বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ১৮ বছর ধরে আমি দইয়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষের ব্যবসা। আমার বাবাসহ পূর্ব পুরুষেরা ৩০-৪০ বছর এ ব্যবসা করে গেছেন। দই আমাদের অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার। তাই যুগ যুগ ধরে আমরা এ ব্যবসা করে আসছি।
কমলনগরের দই বিক্রেতা মো. সেলিম ও মো. সুমন জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি দধি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা করে। এক কেজি, দেড় কেজি, দুই কেজি এবং আড়াই কেজির দইয়ের হাঁড়ি বিক্রি করা হয়।
মহিষের দই সর্ম্পকে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. জোবায়ের হোসেন বলেন, লক্ষ্মীপুরের মহিষা দই অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। জেলায় প্রতিদিন ১০ টনের বেশি মহিষের দই উৎপাদন হচ্ছে। দইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মহিষ ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ খামারি ও বাথানিদেরকে নানা ভাবে সহযোগিতা করছে প্রাণী সম্পদ বিভাগ।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৩
এসএএইচ