মৌলভীবাজার: শীত মৌসুম নিয়ে আসে নানা ফসলের সোনালি দিন। কৃষকরা আনন্দসহকারে সে ফসল ঘরে তোলেন।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকির শুকনো হাওরজুড়ে এমন দৃশ্য হাতছানি দেয়। পুরো শীত এবং বসন্ত ঋতুর প্রথমার্থে হাওর আর জলপূর্ণ থাকে না। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ঠিক এ সময়ে কৃষকরা সেখানে আধুনিক পদ্ধতি-পরামর্শে আবাদ করে বাড়তি ফলস ঘরে তুলেন।
এখানকার এবারের কৃষিজাত ফসলটির নাম সূর্যমুখী। হাওরের বুক চিরে হলদে ফুলের সমাহার যেন মনমাতানো। গাছে গাছে হলুদ সূর্যমুখী ফুলের বাগানে সাময়িক সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে মন চায়। বিস্তীর্ণ সূর্যমুখী ফুলের হলদে ভাব দৃশ্যটি যে কারো মনকে আকৃষ্ট করে তোলে অনায়াসে। সারি সারি সূর্যমুখী গাছের ডগায় বড় বড় আকারের ফুল, যেন দিগন্তজুড়ে হলুদের সমারোহ।
সূর্যমুখী ফুলের অপরূপ দৃশ্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চারদিকে হলুদ ফুলের মন মাতানো ঘ্রান আর মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে কৃষকের যত্নের ফসলি জমি। সূর্যমুখী ফুল মানুষকে শুধু আনন্দই দেয় না। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটাতে তেল হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেল উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের প্রণোদনাসহ উৎসাহ দিচ্ছে।
চাষিরা বলেন, সূর্যমুখী চাষ করার পদ্ধতি মোটামুটি সহজ। প্রতি কেয়ার (বিঘা) জমিতে তিন কেজি বীজ, সামান্য সার ও কীটনাশক হলেই পর্যাপ্ত। সবকিছু মিলিয়ে খরচ হয় ২ থেকে তিন হাজার টাকা। ফলন ভালো হলে কৃষকের লাভ খুবই ভালো হয়। তাই দিন দিন এ চাষের প্রতি কৃষকরা ঝুঁকছেন বেশি।
সূর্যমুখীর বাগান দেখতে আসা পর্যটকরা বলেন, পড়ন্ত বিকেলে সূর্যমুখীর দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ। সূর্যমুখীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আমরা হাকালুকি হাওরে এসেছি। হাকালুকি হাওর এলাকায় তেলবীজ হিসেবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ যেন দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সরকারি সহায়তায় অল্প ব্যয়ে প্রচুর লাভজনক হওয়ায় সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের আগ্রহের যেন শেষ নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এশিয়ার এ বৃহত্তম হাওরে সূর্যমুখী চাষ হতে পারে অন্যতম সম্ভাবনাময়।
সূর্যমুখী বাগান দেখতে আসা আরেক পর্যটক বলেন, হাওরের বুকে সূর্যমুখীর ফুলগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার এখানে আসতে খুবই কষ্ট হয়।
সূর্যমুখী চাষ করা কৃষক জসিম মিয়া বলেন, আমি প্রায় দুই কিয়ার (বিঘা) জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছি। ফলনও খুবই ভালো হয়েছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সূর্যমুখী চাষ আরোও সম্প্রসারণ করব। সরকারের কাছ থেকে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে পরামর্শের পাশাপাশি বিনামূল্যে বীজ পেয়েছি।
সূর্যমুখী চাষিরা বলেন, সূর্যমুখী বাগান দেখতে আসা অনেক পর্যটক সূর্যমুখী ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছেন এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, প্রণোদনার আওতায় জুড়ীতে ২১০ জন কৃষক সুর্যমুখী চাষ করেছে। এবার উপজেলা থেকে ২১০ বিগা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। চাষকৃত সূর্যমুখীর মধ্যে হাইসান-৩৩, আরডিএস ২৭৫ জাতের আবাদ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জুড়ী উপজেলায় মোট ২৮ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষ হয়েছে। সূর্যমুখী চাষ করে কৃষকরা যাতে লাভবান হয় সেই লক্ষ্যে সরকার কৃষকদের প্রণোদনা দিচ্ছে। সূর্যমুখী ভোজ্য তেল হিসেবে গুণগতমানের দিক থেকে বেশ ভালো। বাজারে সূর্যমুখীর চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় এবং উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষের উপযোগী হওয়ায় এ বছর ভালো ফলনের মাধ্যমে চাষিদের মুখে হাসি ফুটবে বলে আমরা আশা করছি। সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে আমরা নিয়মিত উঠান বৈঠকসহ মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক এবং কৃষিবিদ লুৎফুল বারি বাংলানিউজকে বলেন, জেলায় ধীরে ধীরে সূর্যমুখী চাষের চাহিদা বাড়ছে। দৈনন্দিন তেলের চাহিদা মেটাতে সরিষার পাশাপাশি জেলার প্রতিটি সূর্যমুখী চাষিকে সব ধরনের সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ চাষে রোগ-বালাই ও খরচ কম হওয়ায় কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। আমার সময়কাল থেকেই মৌলভীবাজারে তৃণমূল কৃষকদের মাঝে সূর্যমুখী চাষ ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করতে শুরু করে। আগামীতে এ ফসল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
সূর্যমুখী তেলের উপাদান সম্পর্কে তিনি বলেন, সূর্যমুখী তেল মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে উপকারী ওমেগা ৯ ও ওমেগা ৬, আছে ফলিক অ্যাসিড এবং শতকরা ১০০ শতাংশ উপকারী ফ্যাট। রয়েছে ভিটামিন-ই, ভিটামিন কে মিনারেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। এই তেল সম্পূর্ণ ক্ষতিকারক-কোলেস্টেরলমুক্ত।
হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখীর তেল নিরাপদ বলে জানান এই কৃষিবিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩
বিবিবি/এএটি