সাতক্ষীরা: ‘সকাল হলেই যেন ঠক ঠক... খট খট... শব্দে মেতে ওঠে পুরো গ্রাম। যে যার মতো কাজে ব্যস্ত।
এভাবেই কয়েক হাত ঘুরে প্রস্তুত হয় বালা। ঘরে ঘরে বালা বানানোর এই কর্মযজ্ঞ চলায় সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার উত্তর সখিপুর গ্রামটিই এখন বালা গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এ গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারে উৎপাদিত বালা প্রাথমিকভাবে যায় ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বড় বড় জেলা শহরে। সেখানে হাতে তৈরি খোদাইকৃত এসব বালায় রং পালিশ করা হয়। তারপর তা চলে যায় সারা দেশে।
বালা বানানোর এই কর্মযজ্ঞে শামিল হওয়ায় গ্রামটি থেকে দূর হয়েছে বেকারত্ব। সেসঙ্গে নিজ বাড়িতে কাজ করতে পারার সুবাদে অনেক পরিবারের গৃহিণীরাও যুক্ত হয়েছেন এই কাজে। এতে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিছে তাদের।
উত্তর সখিপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রতিদিন ৮-১০ জোড়া বালায় নকশা করতে পারি। প্রতি জোড়ার জন্য ৬০ টাকা করে মজুরি পাওয়া যায়। বাড়ি বসেই কাজটি করতে পারছি। ফলে ঘরের কাজের পাশাপাশি বালা বানানোর কাজ শিখেছি।
এ গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম বলেন, ডিজাইন ভেদে মজুরিরও ভিন্নতা আছে। সাধারণ ডিজাইনের জন্য ৬০ টাকা জোড়া মজুরি পাওয়া যায়। ইরানি গোলাপসহ কিছু আলাদা ডিজাইন আছে সেগুলোর জন্য ১৮০ টাকা মজুরি পাওয়া। এছাড়া গালা ভরা, পাইপ বানানো ইত্যাদির জন্য প্রতি জোড়ায় ১৩ টাকা করে মজুরি পাওয়া যায়। গড়ে প্রত্যেক কারিগর দিনে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করতে পারেন।
বালা তৈরির কারিগর হাসান আলী বলেন, বছর ১৫ আগে মিজানুর রহমান নামে একজন প্রথমে এই গ্রামে সাতক্ষীরা থেকে এক কারিগর নিয়ে এসে বালা তৈরির কাজ শুরু করেন। তার থেকেই আমরা এই কাজ শিখেছি। আস্তে আস্তে তা পুরো গ্রাম ছড়িযে পড়েছে।
গত ১০ বছর ধরে তিনি এ কাজে যুক্ত উল্লেখ করে বলেন, আমার কাছ থেকেই ১৫-১৭ জন বালা তৈরির কাজ শিখেছে। এ গ্রামের যুবকরা অন্য কাজের চেয়ে এই কাজে এখন বেশি মনোযোগী। কারণ কাজটি স্বাধীন। সবাই ইচ্ছে খুশি মতো কাজ করতে পারে। ইচ্ছে খুশি মতো নিজের আয় বাড়াতে পারে। ঝুঁকি কম। মহাজন বালা দেয়, আমরা ডিজাইন করি। নিজের বাড়িতে বসে কাজ করি। বাড়ির নারীরাও কাজ করতে পারেন। সেসঙ্গে নিজের পুকুর-ঘের দেখাশোনা করি।
বালা তৈরির কারিগর ইয়াকুব হোসেন বলেন, স্বর্ণের দাম অনেকের নাগালের বাইরে। তাই বালা তৈরির কাজে কখনো ভাটা পড়ে না। সব সময়ই আমরা কাজ করতে পারি। এমনকি শুক্রবার ও শনিবার বলে কোনো কথা নেই, প্রতিদিনই কাজ করেন সবাই।
এ গ্রামের আশরাফুল ইসলাম আগে নিজে ডিজাইনের কাজ করলেও এখন নিজের কাজের পাশাপাশি নিজেই কাঁচামাল কিনে অন্যদের কাজ দেন।
তিনি বলেন, একেকটি বালা প্রস্তুতের জন্য কয়েক ধাপের কাজ করতে হয়। প্রস্তুতকৃত বালার জোড়া আকৃতি ভেদে ১২৫ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে এসব বালা রং পালিশ করে আরও বেশি দামে বিক্রি করেন পাইকাররা। তখন খুচরা বাজারে এসব বালার দাম ২০৫ টাকা জোড়া থেকে হাজারো ১২শ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আগে আমরা রং পালিশ করেই বিক্রি করতাম। তখন লাভ আরও বেশি ছিল। কিন্তু সাতক্ষীরা সীমান্ত জেলা হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে বিজিবি ভারতীয় বলে হয়রানি করতো। আটকে দিতো। তাই এখন রং পালিশ ছাড়াই বিক্রি করা হয়। এছাড়া বর্তমানে কাঁচামালের দাম একটু বাড়তি। কিন্তু প্রস্তুতকৃত বালার দাম বাড়েনি। এজন্য লাভ একটু কম হচ্ছে।
তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পেশাটি বেকারত্ব দূর করার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এজন্য বিদ্যমান সংকটগুলো কাটিয়ে সর্বত্র এ কাজ ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বাংলানিউজকে বলেন, তারা আগ্রহী হলে তাদের আধুনিক পণ্য উৎপাদনের প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেবে বিসিক। পাশাপাশি পণ্য মার্কেটিং করার সময় যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২৩
এএটি