রাজশাহী: এটিএম বুথ টাকার মেশিন; এই কথা সবারই জানা। তবে কেবল টাকা নয়, এটিএম বুথে এখন মিলছে বিশুদ্ধ পানি।
কারণ এটি পানির এটিএম মেশিন। এই বুথে একইসঙ্গে রয়েছে হাত ধোয়ারও সুব্যবস্থা। এক এক করে এমন চারটি নিরাপদ খাবার পানির এটিএম ও হাত ধোয়ার বুথ স্থাপন করা হয়েছে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে।
এর প্রথমটি উদ্বোধন করা হয়- ২০২২ সালের ২ এপ্রিল। রাজশাহী মহানগরীর দরগাপাড়ায় এলাকায় স্থাপন করা হয়, পানির প্রথম এটিএম বুথটি। এই বুথ উদ্বোধন করেন- রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
বাকি তিনটি পানির এটিএম বুথ রয়েছে- রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর মোড়, শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ফটকের পাশে ও বহরমপুর মোড়ে।
পানির এটিএম বুথের বিষয়টি ব্যতিক্রম ও দারুণ চমকপ্রদ। তাই এরইমধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে এটি।
মহানগরবাসীর জন্য নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করা এবং হাত ধোয়ার বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি বর্তমানে চলমান।
ঠিক ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতোই একটি আরএফআইডি কার্ড মেশিনের নির্দিষ্ট স্থানে রাখলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসছে বিশুদ্ধ খাবার পানি।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই এটিএম বুথ খোলা থাকছে। আর এই পুরোটা সময় পানি সংগ্রহ করা যাচ্ছে। তবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও এর আশপাশে অধিক সংখ্যক ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকার কারণে ‘ডক্টরস জোন’ খ্যাত রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর মিন্টু চত্বর এলাকায় থাকা বুথটি খোলা রাখা হয় রাত ৯টা পর্যন্ত।
আর যতই দিন যাচ্ছে নিরাপদ পানির এই সেবা পেতে এটিএম বুথের গ্রাহক সংখ্যা ততই বাড়ছে। বুথের সঙ্গে লাগোয়া একটি কক্ষে সবার সামনেই পানি বিশুদ্ধকরণের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়।
বলা হচ্ছে- অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এই এটিএম বুথের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানির মান বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত অন্য যে কোনো পানির চাইতে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর থেকে সরাসরি সংগ্রহকৃত পানি মোটরের সাহায্যে উত্তোলনের পর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তিনটি স্তরে ফিল্টারিং করা হয়। পানি বিশুদ্ধের পরই তা এটিএম বুথের ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করা হয়।
নামমাত্র মূল্যেই মিলছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সবাই তাই দারুণ উচ্ছ্বসিত।
রাজশাহীর স্থানীয় গ্রাহকরা জানান, মূলত পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করতেই তারা শহরের নির্ধারিত এই এটিএমগুলো থেকে পানি নিচ্ছেন।
মহানগরীর দরগাপাড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আরিফ আহমেদ জানান, এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করার সময় তিনি এই পানির এটিএম বুথ দেখতে পান। অন্যদের পানি নিতে দেখে তিনিও গ্রাহক হন। প্রথম প্রথম ভরসা না পেলেও এখন এই পানি ছাড়া অন্য কোনো পানি পান করতে পারেন না। প্রায় এক বছর থেকে এই অত্যাধুনিক এটিএম থেকে পরিবারের সবার জন্য পানি নিয়ে যান। ওয়াটার এটিএম বুথ থেকে নামমাত্র মূল্যে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারায় তারা ভীষণ খুশি। বুথের এই পানি ফোটাতে হয় না। আর পানির মান বাজারে বিক্রি হওয়া বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের চেয়েও উন্নত এবং নিরাপদ।
জাহান জোয়ার্দার নামের আরেক গ্রাহক বলেন, বেশিরভাগ রোগ হয় পানিবাহিত। তাই নিরাপদ পানি পান করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাজার বিশুদ্ধ পানির দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাই অধিকাংশ মানুষ এক রকম বাধ্য হয়েই ওয়াসার পানি পান করেন। তবে যারা মোটামুটি সচেতন এবং সামর্থ্যবান তারা বিশুদ্ধ পানি পান করার চেষ্টা করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন পানি বিশুদ্ধকরণ কোম্পানির বোতলজাত (২০ লিটার) পানি মাস হিসেবে কিনে পান করেন। তবে বোতলজাত সেই পানির দাম ২০ লিটারের দাম পড়ে ৫০ টাকা। আর এটিএম বুথের পানির দাম মাত্র ৮০ পয়সা লিটার।
অর্থাৎ ৫০ টাকায় সাড়ে ৬২ লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। তাই এই এটিএম বুথ স্থাপনের পর থেকে তিনি গ্রাহক এবং এখান থেকে নিয়মিত পানি নিয়ে থাকেন।
এই পানি সংগ্রহ করতে আগে থেকেই নিতে হবে কার্ড। আর এটিএম কার্ডের মতোই দেখতে সেই কার্ডের রেজিস্ট্রেশন খরচ পড়বে মাত্র ৫০ টাকা। এরপর টাকা ফুরালে শুধু রিচার্জ করে নিতে হয়। এটিএম বুথের কর্মীর কাছ থেকেই কার্ড রিচার্জ করা যাবে।
বিশুদ্ধ পানির এই এটিএম বুথে নির্ধারিত এটিএম কার্ডের মাধ্যমে এক লিটার বিশুদ্ধ পানির মূল্য পড়ছে মাত্র ৮০ পয়সা। বর্তমান বাজারে এক লিটার বোতলজাত পানির দাম যেখানে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর বিভিন্ন অফিসে ২০ লিটার জারের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহকৃত পানির জন্য ভোক্তাদের খরচ হয় ৫০ টাকা। সেখানে এই বুথ থেকে পানি নিলে খরচ পড়বে মাত্র ৮০ পয়সা। এটিএম কার্ডে সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে ৯৯৯ টাকা পর্যন্ত রিচার্জ করতে পারবেন গ্রাহকরা।
কারণ, কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয় নামমাত্র মূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ। ড্রিংকওয়েল ও ইকলিসহ কয়েকটি সংস্থার সহযোগিতায় মহানগর এলাকায় আপাতত চারটি নিরাপদ পানির এটিএম বুথ স্থাপন করেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। দুই বছর আগে শুরু এই সেবা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
কম খরচে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে যৌথভাবে ওয়াটার এটিএম বুথ স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যাওয়ার্ড ফর করপোরেট এক্সিল্যান্স (এসিই) পুরস্কার পেয়েছে ড্রিংকওয়েল। তাই সংস্থাটি নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে এই রাজশাহী শহরেও।
তবে এখান থেকে বিশুদ্ধ পানি নিতে এটিএম কার্ডের পাশাপাশি ভোক্তাকে আনতে হবে পানির পাত্রও। রাজশাহী শহরের চারটি বুথে, চারজন ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে, কর্মরত থাকছেন। এটিএম কার্ড প্রবেশের পর বুথের অটোমেশন টেপ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করবে। বিষয়টি সত্যি অনেকটা অবাক করার মতই।
বুথের মনিটরে তাকালেই গ্রাহকরা দেখতে পারবেন কত লিটার পানি নেওয়া হলো আর কত লিটার অবশিষ্ট আছে। তাই অনেকে নিজে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করছেন, আবার উৎসাহিত করছেন অন্যদেরও।
রাজশাহী মহানগর এলাকায় থাকা এসব এটিএম বুথে গিয়ে দেখা গেছে- এর ঠিক ভেতরেই রয়েছে পানি বিশুদ্ধ করার বিজ্ঞানসম্মত অত্যাধুনিক সেই ওয়াটার প্লান্ট। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করা যায় এখানে। আর ঘণ্টায় এক হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করার সক্ষমতা রয়েছে এই অত্যাধুনিক ওয়াটার প্লান্টের।
রাজশাহী মহানগরীর দরগাপাড়া এলাকায় থাকা পানির এটিএম বুথ অপারেটর রাফিউল হাসান জানান, প্লান্টে পানি বিশুদ্ধের পর একটি বিশালাকৃতির রিজার্ভ ট্যাংক হয়ে পাইপ লাইন দিয়ে সরাসরি তা চলে যায় এটিএম বুথে। সেখান থেকে এটিএম কার্ড ব্যবহার করে খুব সহজেই বাইরে থেকে পানি সংগ্রহ করেন গ্রাহকরা। আর এখানকার গ্রাহক বা সদস্য হওয়া হওয়া যায় খুব সহজেই।
তিনি বলেন, কেউ চাইলে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত যে কোনো একটি বুথে গিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটেই ৫০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে পারেন। প্রথমে ৫০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে এটিএম কার্ডটি দেওয়া হবে। যেটির কোনো মেয়াদ নেই। অর্থাৎ যতদিন চাইবেন ততদিনই ব্যবহার করা যাবে। কার্ড নেওয়ার সময় ৫০ টাকা রিচার্জ করতে হয়।
এদিকে দ্রব্যমূল্যের বাজার যখন আকাশচুম্বী। তখন এই এটিএম কার্ডে মাত্র ৫০ টাকা রিচার্জ করে সাড়ে ৬২ লিটার বিশুদ্ধ পানি পেয়ে যাচ্ছেন অনায়াসেই। আর কীভাবে কী করবেন তা খুব সহজ ও সাবলীলভাবে লেখা আছে প্রতিটি বুথের সামনেই। এটিএম বুথের বাইরেই বিশুদ্ধ পানির দাম ও তার গ্রাহক রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম লেখা আছ।
রাজধানী ঢাকার বাইরে এমন পানির এটিএম বুথের ধারণা হয়ত অনেকের কাছে কিছুটা অদ্ভুত ও নতুন লাগতে পারে।
তবে নতুন হলেও বিশুদ্ধ পানির এই বিশেষ ও ব্যতিক্রম ব্যবস্থাটি চমকপ্রদ এবং নিরাপদ। তাই উদ্ভাবনী এই পানির ‘এটিএম বুথ’ রাজশাহীর মানুষের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছে।
রাজশাহীতে কর্মরত ড্রিংকওয়েলের সেবা প্রকৌশলী আলিম-উল-রাজি জানান, পানির মানদণ্ডের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা এই প্রকল্পটি রাজশাহীতে চলমান রেখেছেন। যা এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের আস্থা জোগাতে সক্ষম হয়েছে। তারা ভবিষ্যতেও বুথ থেকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ড্রিংকওয়েল ও ইকলি কয়েকটি সংস্থার সহযোগিতায় মহানগরীতে চারটি নিরাপদ পানির এটিএম বুথ পর্যায়ক্রমে স্থাপন করা হয়েছে। প্রথমটি উদ্বোধনের পরই ভালো সাড়া মিলেছে। তারা চাহিদার বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। চাহিদা বাড়লে পরে আরও বেশ কয়েকটি পানির এটিএম বুথ স্থাপন করা হবে। কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, নামমাত্র মূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই আমাদের লক্ষ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪
এসএস/এসএএইচ