ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

৪০০ বছরের ঐতিহ্য

বাঘায় দুই বাংলার মিলন মেলা

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৫
বাঘায় দুই বাংলার মিলন মেলা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাজশাহী: ঈদ-উল ফিতর এলেই রাজশাহীর পূর্ব-সীমান্ত ঘেঁষা মানুষেরা আনন্দে মেতে ওঠেন বাঘার ঈদমেলাকে ঘিরে। আর মেলারও প্রাণ এ মানুষই।

মেলা আর মানুষ যেন একে অপরের পরিপূরক।

প্রতি বছরই বাঘায় বসে ঈদমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের আগের দিন থেকে দিন থেকে যথারীতি মেলা শুরু হয়েছে। বাঘার এই ঈদমেলার রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য। তাই, এ মেলা এখানকার মানুষের কাছে অনেক আবেগ আর গভীর আগ্রহের।

পুরনো স্মৃতিতে নতুন করে আঁচড় কাটে বাঘার ঈদমেলা। সে কারণে বছর ঘুরে এলে এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকেন এখানকার সব মানুষ। যাদের স্বজনেরা সীমান্তের ওপারে থাকেন, তারা বছরের নির্দিষ্ট এই সময়টা বেছে নেন একে অপরের সঙ্গে দেখা করার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাদের বাস, তারাও ছুটে আসেন এখানে।

পাঁচশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় বর্তমানে লাখো মানুষের সম্মিলন ঘটে। দেখে মনে হয়, যেন গ্রামের মেঠোপথ ছুঁয়ে ধনী-গরিবের মিলনমেলা বসেছে। কখনো রোদ, কখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তারপরও বাধা মানে না। ক্ষণে ক্ষণে সমাবেত মানুষের ভিড় বাড়তেই থাকে। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও সব সম্প্রদায়ের মানুষই এ সময় ছুটে আসেন এ মেলায়। সর্বজনীন এই মেলায় দেশের দূর-দূরান্ত থেকে জড়ো হন সবাই।

রাজশাহীর বাঘার ঐতিহাসিক ঈদমেলা এবার সাড়ে ১৮ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাঘা মাজার শরীফ চত্বরে মাত্র ১০ দিনের জন্য উন্মুক্ত ডাকের মাধ্যমে এই মেলার ইজারা দেওয়া সম্পন্ন করা হয়।

এবার মেলার ইজারা পেয়েছেন, বাঘা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রহমান। এর আগে গত বছর ঐতিহ্যবাহী এই মেলার ইজারা দেওয়া হয়েছিল ২০ লাখ ২০ হাজার টাকায়।

আব্বাসীয় বংশের হযরত শাহ্ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (র.) ও তার ছেলে হযরত আবদুল হামিদ দানিসমন্দের (র.) সাধনার পীঠস্থান রাজশাহীর বাঘা। আধ্যাত্মিক দরবেশের ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ঈদ-উল ফিতরে আরবি শওয়াল মাসের ৩ তারিখে ধর্মীয় ওরস মোবারক উৎসবকে সামনে রেখে বাঘা ওয়াক্ফ এস্টেটের উদ্যোগে বিশাল এলাকা জুড়ে এ মেলার আয়োজন করা হয়।

শর্ত থাকায় এবার ঈদমেলায় সার্কাস ও যাত্রা প্যান্ডেল স্থাপন করতে পারেননি আয়োজকেরা। বর্তমানে ঈদমেলায় নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এখানে স্টলের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। বেচাকেনা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। পাওয়া যাচ্ছে রকমারি মিষ্টি, খেলনা, মনিহারিসামগ্রী, লোহা ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্র, মাটির তৈরি খেলনাসহ সদরঘাটের পান। মেলাকে ঘিরে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে, গ্রামীণ খেলাধুলা। আর মেলা প্রাঙ্গণে ওরস মোবারককে ঘিরে সারারাত চলছে ভক্তদের জিকির, সামা কাওয়ালি। ভক্ত ও আগ্রহী মানুষেরা এতে যোগ দিচ্ছেন।

প্রতি বছরই পাপ মোচন ও পূণ্য লাভের আসায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাঘায় আসেন পবিত্র ওরস মোবারকে অংশ নিতে ও মাজারে নামাজ আদায় করতে। তাই, বাঘা ওয়াক্ফ এস্টেট কর্তৃপক্ষ এখন ব্যস্ত। সুশৃঙ্খল আয়োজন বজায় রাখতে তাদের চেষ্টার অন্ত নেই।

শিল্প মহিমার বিস্ময় জাগরিত স্থাপত্য নকশার অনন্য নিদর্শন বাঘা শাহী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের উত্তরে বাঁদিকে হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহ্দৌলার (র.) মাজার শরীফ।

শাহী মসজিদের উত্তরে খানকা বাড়ির ভেতরে তার ছেলে হযরত শাহ্ আবদুল হামিদের (র.) মাজার শরীফ রয়েছে। তারা প্রায় ৪০০ বছর আগে সুদূর বাগদাদ থেকে পাঁচজন সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য রাজশাহীর বাঘায় এসেছিলেন। তারা রাজশাহীর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।

নিজের চরিত্রের মাধুর্য, ব্যবহার ও আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেন। এক পর্যায়ে ওই এলাকার জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারে সাফল্য পান। ধর্মীয় ওই ওরসকে কেন্দ্র করেই প্রতি বছর ঈদ-উল ফিতরের মেলা বসে। বছরের পর বছর ধরে বাঘা ওয়াক্ফ এস্টেট পরিচালনা কমিটির আয়োজনে ওরস ও ঐতিহ্যবাহী এই ঈদমেলা পরিচালনা করে থাকে।

মেলায় বেড়াতে আসা ৮০ বছরের আবদুস সোবহান মণ্ডল জানালেন, মূলত ওরসকে কেন্দ্র করেই মেলার আয়োজন। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদ-উল ফিতরের উৎসব মানেই বাঘার ‘ঈদমেলা’। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় বাঘা উপজেলার অনেকের বিয়ে হয়েছে ভারতে। বছরের সব সময় যাতায়াত না থাকলেও ঈদ-উল ফিতরে বাঘার মেলাকে ঘিরে তারাও আসেন স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে।

তার বাবার কাছ থেকে শোনা গল্পের স্মৃতিচারণ করে সোবহান মণ্ডল বলেন, এক সময় বাঘার মেলাকে ঘিরে ভারত থেকে অনেকে মানুষ আসতেন। ঈদের আগের দিন ভারত থেকে জামাইসহ মেয়েরা চলে আসতো বাপের বাড়ি। মেলায় ঘুরে কয়েকদিন থেকে সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে আবার ফিরে যেতো। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। বাবা-মা অপেক্ষা করেন ঈদ এলে তাদের মেয়ে বাড়ি আসবে।

ঈদমেলার ঐতিহ্যবাহী আর্কষণ হলো পল্লীমেলা। বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ মেলার গন্ধ। কখনও ঋতু, কখনও কৃষি, কখনও নববর্ষ, কখনও ঈদকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। কিন্তু ঈদ-উল ফিতরের উৎসবকে কেন্দ্র করে এত বড় মেলা দেশের অন্য কোথাও হয় বলে জানা যায়নি।

বাঘা মাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম রইস বলেন, ঈদমেলার বিস্তৃতি প্রতি বছরই বাড়ছে। বাড়ছে লোক সমাগমও। মূলত বছরের এই সময়টিতে মেয়ের পরিবারের লোকজন জামাইয়ের পরিবারকে ঈদ উৎসবের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। মেলা দেখতে আসেন পর্যটকেরাও। এতে মেলা লাখো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়, যা এখন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ইতিহাস অনুযায়ী এখানে ছিল উপমহাদেশের প্রথম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়াও মাজার শরীফের পাশে রয়েছে বিশাল এক দিঘি। বাঘা শাহী মসজিদের ছবি ৫০ টাকার নোটে প্রতিকৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ওরস ছাড়াও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার মনোবাসনা পূরণের জন্য হাজার হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে বাঘা শাহী মসজিদ ও মাজার শরীফে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৫
এসএস/এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।