ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

কি যাদু আছে শাজাহানের কাবাবে!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৫
কি যাদু আছে শাজাহানের কাবাবে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে চৌরঙ্গীর সামনে একটি ভ্যানগাড়ি ঘিরে ভোজনরসিকদের জটলা। যাদের সবাই কাবাব-রসিক।

‘বিসমিল্লাহ শাহী কাবাব’। সাশ্রয়ী মূল্যে নানা ধরনের কাবার বিক্রি হয় এই ভ্যানে। সবার চোখ খাবারের প্লেটের দিকে। সে সময় ভ্যানগাড়ির সামনে থামলো লেটেস্ট মডেলের একটি ল্যান্ড ক্রুজার। কাবাবের প্লেট থেকে সবার চোখ উঠে গেলো কপালে। কারণ গাড়িটির সামনে জাতীয় সংসদের স্টিকার। গাড়ি থেকে নেমে আসা ব্যক্তিটি মিশে গেলেন কাবাবের ভ্যানকে ঘিরে থাকা ভোজন রসিকদের জটলায়। ফুটপাতে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে নিজেই নিতে থাকলেন রকমারি সব কাবাবের স্বাদ।

থরে থরে ঝোলানো কাবাবের স্টিক। ভ্যানের মধ্যেই ভাজা হচ্ছে গরুর মাংস। এসবই রানের অংশের মাংস। এক শিকে ৫ টুকরো কাবাব। দাম মাত্র ২০ টাকা। দুই শিক ৪০। শিক ছাড়াও রয়েছে বটি কাবাব। তিল্লির ছড়াছড়ি। এ ছাড়াও দেখা গেলো ভুরি দিয়ে তৈরি বিশেষ আরেক ধরনের কাবাব।

আম জনতা থেকে সংসদ সদস্য সবারই ভিড় কেড়ে নেয় কৌতূহলী দৃষ্টি। কি যাদু আছে আসলে এই কাবাবে!

‘আসলে এটা ভাষায় প্রকাশের নয়। আমি নামিদামি রেস্তোঁরা কিংবা পাঁচ তারকা হোটেলের বার বি কিউ তে-ও এমন স্বাদ কখনো পাইনি’- কাবাবের প্লেট হাতে জানালেন নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ মোঃ শফিকুল ইসলাম শিমুল।

নিজ নির্বাচনী এলাকা নাটোর থেকে রাজধানীতে প্রবেশের আগে সাভারে এই কাবাবের স্বাদ নিয়ে তবে নিজ গন্তব্যে যাত্রা তার নিয়মিত অভ্যাস। এমনটি জানিয়ে বাংলানিউজকে তিনি বললেন,‘যতই ব্যস্ততা আর ঢাকায় ফেরার তাড়া থাকুক না কেন, এই কাবাবের স্বাদ নিয়ে তবেই আমার রাজধানীতে ফেরার শান্তি। ’

সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পূর্বদিকে রাজাসন রাস্তায় প্রবেশের আগে চৌরঙ্গী মার্কেটের সামনে দেখা মিলবে এই বিসমিল্লাহ শাহী কাবাবের। ভ্রাম্যমান দোকানে করে এভাবেই ঠিক এই স্থানটিতেই গত ২২টি বছর ধরে কাবাব বিক্রি করছেন কুড়িগ্রামের শাহজাহান।

তিনি রৌমারী উপজেলার কোমরভাঙ্গি গ্রামের আবু তালেবের ছেলে। এই ছোট্র কাবাবের দোকানই ভাগ্য খুলে দিয়েছে শাহজাহানের। সাভার পৌর এলাকার ইমান্দিপুরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। লেখা পড়া শিখিয়েছেন সন্তানদের। বড় ছেলে জুবায়ের আহমেদ মানিক। এইচএসসি পরিক্ষার্থী। মেয়ে সানজিদা ও খোদেজা স্কুলশিক্ষার্থী।

প্রতিদিন গড়ে আধামণ মাংসের কাবাব বিক্রি হয় এখানে। ৬ থেকে সাত হাজার টাকার কাবাব বিক্রি করে লাভ থাকে হাজার থেকে ১২’শ টাকা।  

বিকেল ৪টায় কাবারের পসরা সাজানো দোকানটি চলে আসে এখানে। রাত সাড়ে ১১ টা কি ১২ টা অবধি ভিড় লেগে থাকে ভ্রাম্যমান এই কাবাবের দোকান ঘিরে।

দোকানটির সামনে হাল মডেলের ল্যান্ড ক্রুজারে চেপে আসা ব্যক্তিটিকে দেখেই কৌতূহল জাগে। চোখে চশমা। হাতে দামী মুঠোফোন। সাধারণ মানুষের সাথে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাবাব খাচ্ছেন তিনি। সাদা পাঞ্জাবীর বুকে শোকের চিহ্ন থাকায় বুঝতে অসুবিধা হয় না ব্যক্তিটি ক্ষমতাসীন দলের নেতা। এই মানুষটিকেই ঘিরে যত না কৌতূহল তার চেয়ে বেশি যেন গাড়িটি ঘিরে।

মানুষটি ততক্ষণে মিশে গেছেন অন্যসব কাবাব রসিকের ভিড়ে। কিন্তু গাড়িটিই যেন জানান দিচ্ছিল আমজনতার সাথে মিশে থাকা মানুষটি জাতীয় সংসদের একজন সদস্য।

দেখা গেলো, পাঞ্জাবী পড়া মানুষটি ফুটপাতের ওপরে দাঁড়িয়েই কাবাবের স্বাদ নিচ্ছেন। আর পথচলতি মানুষদের কেউ তাকে ঠেলে সামনে ছুটছেন। সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। কখনো সরে দাঁড়াচ্ছেন। কখনো বা জায়গা করে দিচ্ছেন পথচলতি মানুষদের। কাছে গিয়ে কাবাব বিক্রেতাকে প্রশ্ন করতেই বেরিয়ে আসে তার পরিচয়।

তখনই বাংলানিউজের সাথে কথা হয় তার। আলহাজ মোঃ হাসান আলী সরদারের নাটোর কাপাঁনো ছেলেটি ফুটপাতের ভোজনরসিক। বিষয়টি কি বেমানান নয়।

চটজলদি উত্তর:‘দেখুন, আমি এখানে নিতান্তই খাবারের স্বাদ নিতে আসা একজন মানুষ। একমাত্র এই কাবাববিক্রেতা তার ছেলে আর পাশের হালিম বিক্রেতা ছাড়া কেউ আমার পরিচয় জানেন না। আমিও চাই না তারা আমার পরিচয় জানুক। আমি দীর্ঘদিন ধরেই কাবাবের স্বাদ নিতে এখানে আসি। যখন উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম তখনো আসতাম। সংসদ সদস্য হবার পরও আসছি। আমার পদ কিংবা মর্যাদায় হয়তো পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এই কাবাবের স্বাদে তো পরিবর্তন নেই---সবসময় জিভে জল আনে। আমি একা খাই না। মাঝে মাঝে বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের জন্যেও নিয়ে যাই এখানকার কাবাব। ’

অসাধারণ কাবাবের যাদুতে সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করে রাখা শাহজাহান নিজেও জানেন না ঠিক কোন যাদুতে একজন সংসদ সদস্য তার কাছে ছুটে আসেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাবাবের স্বাদ নিতে।

শাহজাহানর ভাষায়, ‘সাধারণ মানুষদের সাথে দাঁড়িয়ে উনি কাবাব খাচ্ছেন এটা দেখতে আমার ভালো লাগে। কখনো নিজের পরিচয় দেন না। আমি একদিন উনার ড্রাইভারের মাধ্যমে উনার পরিচয় জেনেছি। এটাই আমার কাছে ব্যতিক্রম লাগে। ’

পাশের দোকানদার কাক্কু হালিমের শাজাহান বাংলানিউজকে জানান, একদিন রাতে এই পথে যাবার সময় উনার গাড়ি দেখে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান-ও এই ফুটপাতের এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে ফুটপাতের খাবারের ক্রেতা হতে পরে আর দেখা যায়নি তাকে। শিমুল সাহেব নিয়মিত। মাসে অন্তত চারবার হলেও এখানে দেখা মেলে তার।

তবে এসবে নজর নেই শাহজাহানের। ভোজনরসিকদের মুখে জল আনা কাবার তুলে দেওয়াই যেন তার ব্রত। সাধারণ পথচলতি মানুষদের মাঝে কিছু অসাধারণ মানুষ তার দোকানে চলে আসায় বেশ সন্তুষ্টু তিনি।

‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি কাবাব বিক্রি করে ভালো আছি। বেশ চলছে আমার সংসার। সহাস্যে তপ্ত কড়াইয়ে কাবাব ভাজতে ভাজতেই কোমল উত্তর শাহজাহানের। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৫
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।