ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

পাশে পুলিশ বক্স, অবহেলায় পড়ে আছে প্রথম শহীদের সমাধি

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
পাশে পুলিশ বক্স, অবহেলায় পড়ে আছে প্রথম শহীদের সমাধি ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: দিনটা ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। অন্যান্য দিনের মতো সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফারুক ইকবাল।

দু’চোখ তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। মুক্তিপাগল ছেলেকে আটকাতে ছুটে এলেন মমতাময়ী মা। ঘরের বাইরে যেতে বার বার নিষেধ করতে থাকলেন ছেলেকে।
 
কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের সব ধ্যান-জ্ঞান সপে দিয়েছেন যে ছেলে তাকে আটকে রাখবে কে? তাইতো মমতাময়ী মায়ের ভালোবাস-নিষেধাজ্ঞাও আটকে রাখতে পারলো না ফারুককে। ছেলেকে স্নেহের ডোরে আটকাতে ব্যর্থ মা নিজ হাতে পরম আদরে দুধ-ভাত খাইয়ে বিদায় দিলেন।
 
মাকে ঘরে রেখে এই মুক্তি পাগল যুবক ছুটে গেলেন নিজের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবুজার গিফারী কলেজে। ইন্টারমিডিয়েটের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফারুক তখন কলেজটির ছাত্র সংসদের (ছাত্রলীগ) সাধারণ সম্পাদক।
 
কলেজ প্রাঙ্গণে ঘণ্টা খানেক বৈঠক করে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তুললেন মালিবাগ থেকে রামপুরা অঞ্চল।

দুপুর দেড়টার দিকে রামপুরা টিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) ভবনের কাছে মিছিল নিয়ে আসতেই বাধার মুখে পড়লেন পাক সেনাবাহিনীর। সামনে থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়া ফারুককে ডেকে নিলেন পাক বাহিনীর সদস্যরা।
 
মিনট দুয়েকের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সহযোদ্ধাদের কাছে ফিরে আসছিলেন ফারুক। কিন্তু কাপুরুষ পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পেছন থেকে ছুড়লেন বুলেট। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ফারুক।
 
সহযোদ্ধারা তাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। গুলিবিদ্ধ ফারুককে নিয়ে তারা ছুটে গেলেন ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু সহযোদ্ধাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চির নিদ্রায় চোখ বুঝলেন ফারুক।
 
সহযোদ্ধারা মেডিকেল থেকে ফারুকের নিথর দেহটি নিয়ে আসলেন বর্তমান মৌচাক মোড়ে। এলাকাবাসীর দাবি অনুযায়ী সেখানেই সমাহিত করা হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ফারুক ইকবালকে।
 
পরের ঘটনাটি ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করে মালিবাগে অবস্থিত নিজ পৈত্রিক ঘরে ফির আসছিলেন দেশের আর এক শ্রেষ্ঠ সন্তান মো. তছলিম। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি জীবিত তছলিমকে ফিরতে দিলো না বাবা-মায়ের কাছে।

বুড়িগঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় নৌকা ডুবিতে তছলিম চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এলাকাবাসীর দাবি অনুযায়ী তাকেও সমাহিত করা হলো মৌচাক মোড়ে শহীদ ফারুকের পাশেই। মৌচাক মোড়ের সেই স্থানটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন জাতীর শ্রেষ্ঠ এই দুই সন্তান।
 
তাদের প্রতি সম্মান জানাতে ২০০৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে সমাধিস্থলে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। নাম দেওয়া হয় ফারুক-তছলিম স্মৃতি চত্বর। একই সঙ্গে মৌচাক থেকে রামপুরা অভিমুখী সড়কটির নাম দেওয়া হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ইকবাল ও তছলিম সড়ক।
 
কিন্তু যান্ত্রিক শহরের নাগরিকরা জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেন ভুলেই গেছে। চারিদিক থেকে ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে চেপে ধরা হয়েছে ফারুক-তছলিমের সমাধিস্থল। গড়ে তোলা হয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এমকি সমাধিস্থলেই পায়খানা-প্রসাব করতেও দ্বিধাবোধ করছে না বিকৃত মানসিকতার কিছু মানুষ।

ফারুক-তছলিমের সমাধিস্থলের উপর বসেছে পুলিশ বক্স। হলুদ রঙের সেই ঘরটিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে ‘মৌচাক চত্বর পুলিশ বক্স, ডিএমপি, ঢাকা। ’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমাধিস্থলের উপর বানানো সেই পুলিশ বক্সের বাইরে চেয়ার পেতে আয়েশি ভঙ্গিতে আড্ডা দিতেও দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের।
 
সেখানে দায়িত্বরত এক ট্র্যাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মৌচাকে ট্র্যাফিকের দয়িত্বে পালন করা সব সদস্যই এই পুলিশ বক্সে বসেন। আর যে ময়লা-আবর্জনা দেখা যাচ্ছে তা রাস্তা দিয়ে চলাচলকারীরাই ফেলেন। এতে আমাদের কিছু করার নেই।
 
যোগাযোগ করা হলে শহীদ ফারুক ইকবালের মা বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চের ১ তারিখ থেকেই নানা মিছিল মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফারুক। ৩ মার্চ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমি বাইরে যেতে ওকে নিষেধ করি। কিন্তু ফারুক আমাকে বলে বঙ্গবন্ধু অনেক দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই কাজগুলো করতে হবে। দেশকে স্বাধীন করতে অনেক কাজ করতে হবে, আমাকে যেতে দাও মা। দেশের প্রতি ছেলের টান দেখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। যাওয়ার সময় দুধ-দিয়ে ভাত খাইয়ে দেই। ওই খাওয়াই ছিলো ফারুকের শেষ খাওয়া।

এ সময় মায়ের পাশে বসে থাকা ফারুকের বড় ভাই জুলফিকার হারুন বাংলানিউজকে বলেন, শহীদ হওয়ার পর ফারুক আর শুধু আমাদের ছিল না। তখন সে সমগ্র এলাকাবাসীর আপনজনে পরিণত হয়েছিল। এলাকাবাসীর দাবির কারণেই মৌচাক মোড়ে ফারুককে সমাহিত করা হয়।
 
তিনি বলেন, আগে আমরাই স্মৃতিস্তম্ভটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতাম। কিন্তু ফ্লাইওভারের কাজ চলার কারণে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভটির উপর বক্স বসিয়েছে। আবার অনেকে স্মৃতিস্তম্ভটির চারিদিকে নানা রকম ব্যানার ঝুলিয়ে রেখেছে। এটি দেখে খুব খারাপ লাগে।
 
আপনারা এটির প্রতিবাদ করেননি? এমন প্রশ্ন করলে জুলফিকার হারুন বলেন, ট্র্যাফিক পুলিশদের আমরা নিষেধ করেছিলাম। এর উত্তরে তারা বলেছিলো, দেশের জন্য অনেকেই আত্মত্যাগ করে, আপনারাও মানুষের উন্নয়নে একটু আত্মত্যাগ করেন। ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হলে পুলিশ বক্স সরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর আমরা আর কিছু বলিনি।
 
ট্রাফিক পুলিশের কার কাছে একথা বলেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নামটা এখন মনে নেই। তবে তিনি ট্র্যাফিক পুলিশের বড় কর্মকর্তা ছিলেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
এএসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।