ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বরফঢাকা শীতের দেশে এস্কিমোরা কেমন আছে

আতিফ আতাউর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
বরফঢাকা শীতের দেশে এস্কিমোরা কেমন আছে

জেঁকে আসছে শীত। কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হবে শরীরে শীতের কামড়ের প্রকোপ।

এসব সত্ত্বেও শীতকাল আমাদের জন্য পিঠা-পুলি, খেজুররস, গুঁড়মুড়ি আর নানা রকম উৎসবের ঋতু। কিন্তু পৃথিবীতে এমন বহু দেশ আছে যেখানে শীত মানে শুধুই বেঁচে থাকার সংগ্রাম। পৃথিবীর উত্তর সীমানায় এমন বহু দেশ রয়েছে যেখানে শীতের সময় সূর্যের সাক্ষাত পাওয়া তো দূরের কথা, ভাবাই যায় না। এমনকি উত্তর সুমেরু প্রদেশের এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে এক দিন ও এক রাতেই বছর ঘুরে যায়। বরফঢাকা শীতের এই দেশগুলোতে সূর্য টানা ৬ মাস দেখা দিয়ে বাকি ৬ মাসের জন্য হারিয়ে যায়। একটি বছরের অর্ধেক সময় এসকল জায়গার অধিবাসীদের কাটাতে হয় দিনের আলোয়। বাকি অর্ধেক সময় তাদের আঁধারে কাটে। তারপরও, প্রচণ্ড শীত ও দিন রাতের এমন ভারসাম্যহীনতার মধ্যেও তারা মানিয়ে নিয়েছে তাদের জীবনযাপন। তেমনি একটি জাতি ‘এস্কিমো।

শীতের দেশে গাছপালাও কম। সারাবছর বরফে ঢাকা থাকে বলে গাছপালা খুব একটা দেখা যায় না সেখানে। যত উত্তরে যাওয়া যাবে, ততই কমতে থাকবে গাছপালা। উদ্ভিদের মতো এসব জায়গায় প্রাণীর সংখ্যাও নিতান্ত কম। সাদা ভালুক, সীল, সিন্দুঘোটক ও পেঙ্গুইন জাতের জীবজন্তুরাই কেবল বরফ আচ্ছন্ন এই সমস্ত জায়গায় বসবাস করে। পাশাপাশি নানা জাতের মানুষেরও সন্ধান মেলে।

উত্তর আমেরিকা, পূর্ব সাইবেরিয়া, গ্রিনল্যান্ড সুমেরুবৃত্তীয় প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত দেশ। এসব দেশই মূলত শীতের দেশ হিসেবে পরিচিত। এখানে যে সমস্ত মানুষেরা বাস করে তাদেরই বলা হয় এস্কিমো। এস্কিমোরা দেখতে ছোটখাটো, চ্যাপটা নাক ও নরুন চেরা চোখ। এস্কিমোরা দেখতে যেমন অদ্ভুত, তেমনি অদ্ভুত তাদের পোশাক-আশাক। লম্বা লোমযুক্ত সীলের চামড়ার জামা ও পাজামা তাদের প্রধান পোশাক। এক প্রকার জুতা পরে তারা, যা তাদের হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখে। মাথায় পরে লোমের টুপি, সঙ্গে মোটা চামড়ার হাতমোজা।

এস্কিমোরা খুব একটা গোসল করে না। তাছাড়া ওমন শীতের দেশে, যেখানে পোশাক খুললেই হাড়কাঁপানো শীত তীরের মতো শরীরে বেঁধে, সেখানে কে-ই বা চায় গোসল করতে। এক আধটু ময়লা যদি এস্কিমো বাচ্চাদের গায়ে লাগে তো এস্কিমো মায়েরাই তাদের চেটে পুটে পরিষ্কার করে দেয়।



এস্কিমোদের প্রধান খাবার মাছ-মাংস। শাকসবজি খুব একটা জন্মে না এসব দেশে।

এস্কিমোদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ‘স্লেজ গাড়ি’। চাকাবিহীন দুমাথাওয়ালা নৌকার মতো দেখতে এই গাড়ি শক্ত বরফের ওপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলে। ‘স্লেজ গাড়ি’ টানে তাদেরই পোষা কুকুর। কুকুরগুলো দেখতে যেমন বড় তেমনি গায়েও তাদের লম্বা লম্বা লোম। এই কুকুর ছাড়া এস্কিমোদের একটি দিনও কল্পনা করা যায় না।



স্লেজ গাড়ি ছাড়াও এস্কিমোরা এক ধরনের নৌকা ব্যবহার করে। ‘কাইআক’ নামের আট থেকে দশ ফুট লম্বা নৌকায় চড়ে এস্কিমোরা মাছ শিকারে বেরোয়। এস্কিমোদের মতো নৌকাগুলোও দেখতে অদ্ভুত। মাত্র দেড় হাত চওড়া এই নৌকার আগামাথা চামড়ায় তৈরি। ‘কাইআক’ নৌকায় একজনের বেশি বসতে পারে না। নৌকার মাঝখানে গোল একটা ফোকর থাকে। তাতেই পা দুটো ঢুকিয়ে বসতে হয় এস্কিমোদের।

এস্কিমোদের দেশে দুটিমাত্র ঋতু। গ্রীষ্মকাল ও শীতকাল। গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ যে ছয় মাস সূর্যের দেখা পাওয়া যায়, সেই সময়টুকুতে কাজের অন্ত থাকে না এস্কিমোদের। ছেলেরা ‘কাইআকে’ চড়ে মাছ ধরতে যায়। বড়রা বেরোয় বর্শা হাতে সীল ঘোটক শিকার করতে। বর্ষায় একটা দড়ি বাঁধা থাকে। সীল যখন আরামে সমুদ্রের ধারে রোদ পোহায় তখন গুঁড়ি মেরে শিকারি এস্কিমোরা এগিয়ে যায়। জলে ডুব দেওয়ার আগেই ঘায়েল করা চাই তাদের। শীতকালে আবার এস্কিমোদের শিকার পদ্ধতি আলাদা। সীল শ্বাস নেয় ফুসফুসের সাহায্যে। শীতকালে শক্ত বরফের মধ্যে গর্ত করে লুকিয়ে থাকে তারা। শ্বাস নেওয়ার জন্য যেই তারা ভেসে ওঠে অমনি শিকারী বর্শা ছুঁড়ে বিঁধে ফেলে। তারপর বর্শার গায়ে বাঁধা দড়ি টেনে তুলে আনে সীল। সীল এস্কিমোদের নানা কাজে দেয়। সীলের মাংস তারা খায়। সীলের চর্বি দিয়ে তারা আলো জ্বালায়। লোম ও চামড়া দিয়ে তৈরি করে জামা-কাপড়।



এস্কিমোরা শীতের সময় খাওয়ার জন্য খাবার সংরক্ষণ করে। গ্রীষ্মকালে মাছ ও মাংস শুকিয়ে নেয়। এসময় তারা থাকে চামড়ার তৈরি ‘টুপিক’ নামক তাঁবুতে।

শীতকালে বরফের দেশে জীবন বড় এক সংগ্রামের নাম এস্কিমোদের কাছে। এসময় বরফের দেশ অন্য এক রূপে ধরা দেয় তাদের কাছে। বরফ জমে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। চারদিক থাকে অন্ধকার সেইসঙ্গে বইতে থাকে সোঁ সোঁ করে হিমেল হাওয়া। ‘টুপিক’ নামের তাঁবুতে তখন আর শীত মানে না এস্কিমোদের। এসময় তারা আলাদা এক ধরনের তাঁবু তৈরি করে। শক্ত বরফ কেটে টালির মতো বানিয়ে নেয়। তারপর সেই টালি একটার পর একটা সাজিয়ে তৈরি করে বাড়ি। এ বাড়ির নামই ইগলু।



ইগলু দেখতে অনেকটা উপুড় করা বাটির মতো। তারপর ছোট ছোট ফাঁক ফোকরে ছোট ছোট বরফের টুকরা ঢুকিয়ে দেয়। টুকরাগুলো টালির ফাঁকে ফাঁকে জমে হাওয়া ঢোকার পথ দেয় বন্ধ করে। আর জানালা তৈরি করে একখণ্ড স্বচ্ছ বরফের টুকরা দিয়ে। ‘ইগলু’তে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। চার-পাঁচ হাত লম্বা একটা সুরঙ্গ পথ পেরিয়ে তবেই পাওয়া যায়  ‘ইগলু’র দরজা। সাধারণত ‘ইগলু’র উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় ফুট। বাড়ির ভেতর সবসময় জ্বলতে থাকে পাথরের তৈরি প্রদীপ। প্রদীপের সলতে তৈরি করা হয় সমুদ্রের শ্যাওলা দিয়ে আর প্রদীপ জ্বলে সীলের তেলে। ‘ইগলু’র চারদিক থাকে বন্ধ, তাই ওই একটি প্রদীপের আলোতেই সারা ঘর গরম হয়ে থাকে। এই গরম ঘরে বাস করেই অপেক্ষার প্রহর গোণে এস্কিমোরা। সে অপেক্ষা আরেকটি গ্রীষ্মকালের। তার দেখা পাওয়া যাবে ছয়মাস পরে। শীতের তীব্র আঁধার ঘেরা ছয়টি মাসের টানা রাত্রি পেরিয়ে।



তবে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় আর আধুনিকতার যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকটাই বদলে গেছে এস্কিমোদের জীবন-যাপন রীতি। তারা এখন কুকুরটানা স্লেজ গাড়ির পাশাপাশি মোটরগাড়িও চালায়। ইগলুতে সীল মাছের তেলের কুপির বদলে সেখানে জ্বলজ্বল করে সোডিয়াম লাইটের আলো। চামড়ার পোশাকের সঙ্গে নানা বর্ণের শীতের কাপড়ও পরে এস্কিমোরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এএফএ/টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।