শিরোনাম পড়েই হয়ত চোখ বড় হয়ে গেছে অনেকের। কেউ কেউ তো প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ভাবতে শুরু করেছেন, মানবদেহে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু আছে নাকি! অবশ্য এ বিষয়ে ধারণা রাখেন যারা, তাদের কারো কারো মাথায় হতে পারে এমন দুয়েকটা অঙ্গের নাম ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
পুরুষের স্তনাগ্র
মানবদেহে নিপল বা স্তনাগ্র এমন একটা সময় তৈরি হতে শুরু করে, যখন ভ্রুণই ঠিকঠাক গঠন পায় না। মাতৃগর্ভে বাচ্চার বয়স ষষ্ঠ সপ্তাহে পড়লে নারী-পুরুষ নির্ধারক হরমোনগুলো, যেমন টেস্টোস্টেরন, এস্ট্রোজেন ইত্যাদি তৈরি হতে ও কাজ করতে শুরু করে। মুশকিল হচ্ছে, এর আগেই নিপল তৈরি হতে শুরু করে। হরমোনগুলো লিঙ্গ নির্ধারণ করে ফেললে পুরুষদের নিপলের পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বস্তুত, পুরুষের নিপল কোনো কাজেই আসে না। তবে তা খুবই স্পর্শকাতর। কখনো কখনো পুরুষ স্তন ক্যান্সারেও আক্রান্ত হয় শুধুমাত্র এই নিপলের কারণে।
সাবক্ল্যাভিয়াস মাংশপেশী
সাবক্ল্যাভিয়াস মাংশপেশী আসলে ত্রিভূজাকৃতির পুরু টিস্যুবিশেষ, যা মানবদেহের পাঁজরের প্রথম হাড়ের সঙ্গে কণ্ঠাস্থি বা কলারবোনকে সংযুক্ত করে রাখে। কাঁধের তলদেশে অবস্থান করা এই পেশী কাঁধকে নড়াচড়ায় সহায়তা করে।
এর প্রয়োজনীয়তা তখনই ছিল, যখন মানবজাতির পূর্বপুরুষরা চার হাত-পায়ে চলাফেরা করত। কিন্তু এখন আর এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কারো কারো ক্ষেত্রে এ পেশী থাকেও না। কারো দেহে মাত্র একটি থাকে, আবার কারো দু’টোই।
প্লিকা সেমিলুনারিস অব কনজাংটিভা
প্লিকা সেমিলুনারিস চোখের তৃতীয় পাতা নামেও পরিচিত। চোখের কোণায় অশ্রুনালীর পরে এটির অবস্থান। যখন চোখ চারপাশে ঘোরানো হয়, তখন ভাঁজবিশিষ্ট এ পল্লব দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে, চোখের এ পল্লব বা পাতা অশ্রু সরবরাহ ব্যবস্থা ও চোখের ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই পল্লব ছাড়া মানবচক্ষু ঠিকভাবে ঘোরানো যেত না, কারণ সেক্ষেত্রে অক্ষিগোলক সরাসরি মিউকাস মেমব্রেন বা কনজাংটিভার সঙ্গে সংযুক্ত থাকত।
তারপরও এর ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মূল কারণ, এই পল্লবের আকার। সবচেয়ে বড় কথা, বেঁচে থাকার জন্য প্লিকা সেমিলুনারিসের অতি প্রয়োজনীয়তাও এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি।
পালমারিস লঙ্গাস পেশী
সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি পেশী, যা হাতের ফ্লেক্সর কার্পি আলনারিস পেশীর সঙ্গে ফ্লেক্সর কার্পি রেডিয়ালিস পেশীকে সংযুক্ত করে রাখে।
পৃথিবীজুড়ে যত মানুষ আছে, তাদের ১৪ শতাংশের পালমারিস লঙ্গাস পেশী নেই। আর দেখা গেছে, এই না থাকাটা তাদের কোনো কিছু ধরা বা হাত বাঁকানোয় কোনোপ্রকার সমস্যার তৈরি করে না। এই পেশী তখনই প্রযোজনীয় ছিল, যখন মানবজাতির পূর্বপুরুষরা গাছে বসবাস করত।
জ্ঞানদাঁত
১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে এই দাঁত জন্ম নেয়। গবেষকরা দেখেছেন, গাছের টিস্যু চূর্ণ করার কাজে এই দাঁত মানবজাতির পূর্বপুরুষদের খুব কাজে আসত। কিন্তু এখন মানুষের মস্তিষ্ক আকারে ছোট হয়ে এসেছে এবং অপ্রয়োজনীয় দাঁতের সংখ্যাও কমে গেছে।
খাদ্যাভ্যাসই এ পরিবর্তনের মূল কারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে জ্ঞানদাঁতের কোনো প্রয়োজনীয়তা তো নেই-ই, উল্টো এ দাঁত আক্রান্ত হলে তা তুলে ফেলাও বেশ দুরূহ।
অ্যারেক্টর পিলি পেশী
স্তন্যপায়ী প্রাণিতে চুল বা পশমের বীজকোষের সঙ্গে যুক্ত থাকে অ্যারেক্টর পিলি পেশী। ভয় পেলে বা যেকোন উত্তেজনায় চুল বা পশম খাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী এটি। বেশিরভাগ প্রাণির ক্ষেত্রে শরীরে কাঁটা দেওয়াটা আত্মরক্ষারই একটা কৌশল হলেও মানবদেহে এর কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই।
বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, প্রাণীর দেহকে তাপ নিরোধক করে তুলতে এ পেশী জরুরি। তবে মানবদেহে পশমের সংখ্যা এত কম যে, এক্ষেত্রে তাপ নিরোধকের প্রশ্নটা সত্যিকার অর্থেই হাস্যকর।
টনসিল
বলা হয়ে থাকে, টনসিল মানবদেহে জীবাণু প্রবেশ ঠেকিয়ে দেয়। দু’টো গুরুত্বপূর্ণ টনসিল নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয়ে থাকলেও গলদেশে বেশ কয়েকটি টনসিল থাকে। যেমন, অ্যাডেনয়েড টনসিল, প্যালাটিন টনসিল, লিঙ্গুয়াল টনসিল ও টিউবাল টনসিল।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টনসিল উপকারের চেয়ে বরং বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। খুব সহজেই এটি সংক্রমিত হয়, যা বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কখনো কখনো অস্ত্রপচার করে টনসিল অপসারণও করতে হয়।
প্যারানাসাল সাইনাস
মুখের অনুনাসিক গ্রন্থিতে বায়ুপূর্ণ সাইনাসের দেখা মেলে। তাদের থাকা, না থাকার বিষয়টি এখন বেশ বিতর্কের। বিশেষ করে সংক্রমণের কারণে যখন এই সাইনাসগুলো ব্যথার সৃষ্টি করে, তখন যেন বিতর্কটাও উসকে ওঠে। মানবজাতির পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে এ প্যারানাসাল সাইনাস বেশ প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ শিকারের জন্য তাদের ঘ্রাণশক্তি প্রখর হওয়া জরুরি ছিল। তবে এখন আর এর খুব একটা প্রয়োজন নেই।
কেউ কেউ দাবি করেন, মানুষের কণ্ঠ সুস্পষ্ট করে তুলতে, চাপ নিয়ন্ত্রণ ও মস্তিষ্কের সামনের অংশের ভার হালকা করাসহ বেশ কয়েকটি কাজ করে থাকে প্যারানাসাল সাইনাস। তবে যে যাই বলুক, সাইনাসের প্রদাহ সর্দি সৃষ্টি করে এবং কখনো কখনো তা ক্যান্সারেরও কারণ।
কক্সিক্সি
মেরুদণ্ডের শেষে ত্রিকোণাকার এই হাড়কে ‘টেইলবোন’ নামেও অভিহিত করা হয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানবজাতির পূর্বসূরিদের লেজ ছিল, তখন এ হাড় শরীরের অতি প্রয়োজনীয় একটি অংশ ছিল। এপস বা বনমানুষদের দেহেও কক্সিক্স পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যোগাযোগ ও দেহের ভারসাম্য রক্ষায় লেজ যথেষ্ট প্রয়োজনীয়। তবে মানুষ যখন থেকে হাঁটতে শিখেছে, তখন থেকেই মানবদেহে লেজ বিলুপ্ত হতে শুরু করে। তবে এই অপ্রয়োজনীয় অংশ দেহ থেকে অপসারণ করা সম্ভব নয়। কারণ এটি বেশ কয়েকটি জটিল লিগামেন্ট, পেশী ও টেন্ডনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
অ্যাপেন্ডিক্স
অ্যাপেন্ডিক্স বেশি পরিমাণে সবজি জাতীয় খাবার হজমে সহায়তা করে। ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্রের মধ্যে এটি অবস্থিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই অঙ্গ সেলুলোজ হজমে সহায়তা ছাড়াও শ্বেতকণিকা তৈরি করে থাকে।
এসব সত্ত্বেও সংক্রমিত হলে অ্যাপেন্ডিক্স ব্যাপক সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কখনো কখনো এসব সংক্রমণ প্রাণনাশীও হয়। সাধারণত এই অঙ্গে সংক্রমণ হলে তলপেটে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাবসহ আরো বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৫
আরএইচ/টিকে
ফিচার
মানবদেহের অপ্রয়োজনীয় কয়েকটি অঙ্গ
রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।