সাগরদাঁড়ি (যশোর) থেকে: ‘দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’- এ আহ্বানে সাড়া দেবে না কোন বাঙালি, কোন কালে? এ যে কবির আহ্বান! বাংলার কবিকূলে যার কাব্য আজও সমান উচ্চতায় মহীয়ান।
আর আজও তা কলকল শব্দ তুলে পাঠকের কর্ণকূহরে বাজে।
কপোতাক্ষের মাঝি হয়ে আজও ছোট্ট ডিঙ্গি নিয়ে ঘাটে বসে থাকেন জামাল গাই। তার কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে, ‘কি সে খরস্রোতা নদী, আজ বুজে গেছে। নদী এখন মরে এতোটুকু। মাঝে বাঁধ দিয়ে বাকি যেটুকু জৌলুস ছিল তাও এখন শেষ। কচুরিপানায় ভরে যাওয়া নদীর যেটুকু এখনো ফাঁকা তাতেই নাও ভাসান মাঝি জামাল গাই’।
দর্শণার্থী, যারা অনেক আশা-ভরসা নিয়ে কপোতাক্ষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, তাদের মনের সাধ মেটাতে নৌকায় তুলে নেন আর কয়েক টান বৈঠা বেয়ে নিয়ে যান কবির বিদায় ঘাটে।
মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে তরুণ কবি যে ঘাট দিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলন অজানার উদ্দেশে। সেই ঘাটেও আবার ঘাট নেই। আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যাতে অবশ্য খোদাই হয়ে আছে কবির অমর কবিতা:
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়ামন্ত্রধ্বনি) তব কল কলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে।
দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা? যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি, এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে, সখে সখা-রীতে
নাম তা'র এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে।
- মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
হ্যাঁ মাইকেলের কথাই হচ্ছে। যশোরের কেশবপুর থেকে পাকা সড়ক ধরে ১৩ কিলোমিটার পার হয়ে গেলে সাগরদাঁড়ি গ্রামে মাইকেলের বাড়ি। দত্তদের বাড়ির ছেলে মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বিশাল এক মূর্তি সাহেবি কেতায় কপোতাক্ষ পারে ঠায় দাঁড়িয়ে।
দেখে মনে হবে, এতো বড়, এত দৃঢ় যেনো দেখছেন সবকিছু। যেনো কোন সে পথিক, বঙ্গে জন্মেছে কিন্তু দাঁড়ায়নি এই কপোতাক্ষের তীরে।
কপোতাক্ষ যে আগের মতো নেই সে কথা আগেই বলেছি।
মাঝি জামাল গাই বলছিলেন, ‘নদীটা বুজে গেছে। যে নদী খরস্রোতা, সাগরের সঙ্গে যার সরাসরি যোগাযোগ তাকে বুজে যেতে হয়েছে। কারণ, এখানকার মানুষের সীমাহীন লোভ। তারা নদীর মাঝে বাঁধ ফেলে ঘের বানিয়ে মাছ চাষ করে মুনাফা লুটেছে। আর কবির নদী, কবিতার নদী গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। টলটলে যার জল, সুন্দর যার অঙ্গে মাখা, সে এখন বড়ই ম্লান’।
জামাল মাঝি বললেন, তিনিও স্বপ্ন দেখেন, একদিন এই নদী আবারও খরস্রোতা হবে। দুগ্ধ স্রোতরূপী হয়ে জন্মভূমির স্তন হয়ে সুধা ছড়াবে। তবে কিভাবে তা জানেন না।
কিছুটা জানেন কবি খসরু পারভেজ। তবে তার স্বপ্নে নদই কেবল নয়, রয়েছে গোটা মধু দত্তের ঐতিহ্যের কথা। তিনি চান এখানে, এই দত্তবাড়ির পরতে পরতে মধুসূদনকে ধরে রাখার যে চেষ্টা তারা করে যাচ্ছেন, তা আরো গোছানো, আরো সুচারু হোক। এখানে গড়ে উঠুক মধুসূদন বিশ্ববিদ্যালয়। তাতে মধুসুদনের কাব্য নিয়ে আরও আরও চর্চা হোক। মানুষ মধুসূদন দত্তকে প্রাণে ধারণ করুক। মধুসূদন একাডেমির পরিচালক আর এই সাগরদাঁড়ির কবিসন্তান হিসেবে এটুকু তার প্রাণের ইচ্ছা বলা চলে।
দত্তবাড়ি ঘুরে দেখা গেলো, শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে। পুরো বাড়িটি একটি জাদুঘরে রূপ পেয়েছে। বাড়ির পুরনো ভঙ্গুরদশা ছিলো। নকশা আর সাজ অক্ষুন্ন রেখে তার নতুন সংস্করণ হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন দত্তবাড়ি কিছুটা দেখার মতো রূপ পেয়েছে। তবে এখানেই যেনো থেমে না যায়।
খসরু পারভেজ জানালেন, তাদের পরিকল্পনায় এই দত্তবাড়ি থেকে কপোতক্ষ নদ পর্যন্ত পুরো অংশটুকু জুড়ে সংস্কার ও গঠনের মধ্য দিয়ে এমনভাবে সাজিয়ে দিতে হবে, যার পরতে পরতে থাকবে মধুসূদন দত্তের উপস্থিতি। স্রেফ পিকনিক স্পট হিসেবে নয়, যারা ঘুরতে আসবেন, তারা এই স্মৃতি জাদুঘরকে তাদের জ্ঞানের আধার হিসেবেও যেনো পেয়ে যান। এ ভূমিই যেনো হয়ে ওঠে সাহিত্য চর্চাকারীদের তীর্থভূমি।
পিকনিক স্পট হিসেবে সাগরদাঁড়ি কিছুটা জনপ্রিয় বটে। সে কথা জানালেন মাইকেল মধুসূদন পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান আনোয়ার হোসেন। দেখা হলো কপোতাক্ষের পাড়ে একটি টেবিল পেতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনাসমগ্র, কবি ও কবিতা, মেঘনাদবধ কাব্য নিয়ে গবেষণাধর্মী একটি বইসহ গুটিকয়েক বই সাজিয়ে বসেছিলেন। যদি দুই-চারটি কপি বিক্রি হয় এ প্রত্যাশায়।
এই লাইব্রেরিয়ান পরে ডেকে নিয়ে গেলেন মাইকেল মধুসূদন পাঠাগারে। সেখানে ১৩০০টিরও বেশি বই রয়েছে। রয়েছে মাইকেলের আঁকা দু’টি দুর্লভ ছবি। তবে সাজসজ্জায় পাঠাগার হিসেবে এটি কোন মানের, তা দেখামাত্র উপলব্ধি করা সম্ভব।
লাইব্রেরিয়ানকে অবশ্য খুশিই মনে হলো। বললেন, শুক্র ও শনিবারে পিকনিক পার্টি আসে। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা এলে এখানে পাঠাগারে বসে বই পড়ে, এটাই তার ভালো লাগে। এই কপোতাক্ষের তীরে মাইকেলকে পাঠে বাঁচিয়ে রাখতে সামান্য হলেও ভূমিকা রাখতে পেরে তিনি খুশি।
আনোয়ার হোসেন জানালেন, তার বাবা এই লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন, এখন তিনি রয়েছেন। সরকার তার ওপর যে দায়িত্বটুকু দিয়েছে তা সুচারুরূপে পালন করতে চান বলেই এই নিষ্ঠা। বই বাইরে ধার দেওয়া হয় না, দুর্লভ বইগুলো যাতে কেউ ছিড়ে না ফেলে সেদিকেও রাখতে হয় পূর্ণ খেয়াল। তবে এই লাইব্রেরির সংস্কার হবে। অনেক বড় লাইব্রেরি হবে সেটা তারও স্বপ্ন।
খসরু পারভেজ জানালেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ বিষয়টিতে আগ্রহী। বছর কয়েক আগে তিনি এখানে সফর করে গেছেন। তখন তারই একান্ত আগ্রহ থেকে এখন মধুসূদন একাডেমি, স্মৃতি জাদুঘর একটি রূপ পেয়েছে। বাকি বিষয়গুলোও তার নেতৃত্বের সরকারই সম্পন্ন করবে বলেও দৃঢ় বিশ্বাস খসরুর।
আর মোটে দিনকয়েক পর এখানে বসবে প্রতি বছরের নিয়মিত আয়োজন সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা। সে মেলায় অংশ নিতে দেশবরেণ্যরা আসবেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীও আসবেন। তার পথপানে, আর মুখপানে চেয়ে রয়েছেন এখানকার সবাই। একজন সুশিক্ষিত সংস্কৃতিমনা সংস্কৃতিমন্ত্রীর হাত ধরে মধুসূদন দত্তের বাড়িটি পুরোপুরি স্মৃতি জাদুঘরে রূপ নেবে- সেটাই তাদের কাম্য।
আর হ্যাঁ, সেসব যদি হয়, মক্তবটি যেনো বাদ না পড়ে। দত্তবাড়ি থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরেই হবে এই মক্তব। যেটি মূলত একটি মসজিদ। ১৮ শতাব্দীতে গড়া এ মসজিদের সামনে একটি সাইনবোর্ডে গর্বিত উচ্চারণ: ‘এই সেই মসজিদ, এ মসজিদে শিশু মধুসূদন ফারসি ভাষা শিখতেন। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৫
এমএমকে/এএসআর