ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

শান্তিনিকেতনে আমাদের তীর্থযাত্রা

মো. মহিউদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
শান্তিনিকেতনে আমাদের তীর্থযাত্রা ছবি : সোহেল সরওয়ার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা থেকে ফিরে: কলকাতা থেকে বর্ধমান জেলার বোলপুর। রেলপথে ১৪৬ কিলোমিটার হলেও সড়ক পথে ২১২ কিলোমিটারের রাস্তা।

আমাদের যাত্রা সড়ক পথেই। গন্তব্য শান্তিনিকেতন। সেখানে আছে রবীন্দ্রনাথের অমর কীর্তি। যেখানে বসে অমর কাব্য রচনা করেছিলেন রবি ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের সেই কীর্তি দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক, গবেষকসহ বিভিন্ন শ্রেণির পেশার লোকজন ভিড় করেন সেখানে। কবি গুরুর অসাধারণ এই কীর্তি সবাইকে মুগ্ধ করে। একবার দেখলে ইচ্ছে হয় বার বার দেখতে, যেন ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। ’

শান্তিনিকেতন সম্পর্কে প্রথম জেনেছি রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প ও কবিতা পড়তে গিয়ে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ার সময়। ক্লাসে ময়ূখ স্যারের প্রাঞ্জল আলোচনা রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন সম্পর্কে জানার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে। শান্তিনিকেতন আমার কাছে রীতিমত তীর্থে পরিণত হয়।

বন্ধুরা মিলে তীর্থস্থান ঘুরে আসার পরিকল্পনা হয়েছে বহুবার। কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠেনি। এমএ শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষে শিক্ষা সফরটি যেন শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি হয় এমন আবদার করেছিলাম। রাজি হয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শফিউল আজম ডালিম স্যার। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের গন্তব্য ওই কক্সবাজার। দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া…

পাঠ চুকিয়ে আসার ৫ বছর পর সেই সুযোগ করে দিল বাংলানিউজ। বাংলানিউজের চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিসে কর্মরতরা ভারতের কলকাতা সফরে যাবে জানা হয়েছিল কয়েক মাস আগে। শ্রদ্ধেয় এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন সফরের অনুমতি দিলেন। এবার শুরু হলো আমাদের ভিসা নেওয়ার দৌড়ঝাঁপ। খুব সহজেই ভারতের ভিসা মিললো।

ব্যুরো এডিটর তপন চক্রবর্তী জানালেন ৭ জানুয়ারি সকালে আমরা কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি। এবার যাওয়ার প্রস্তুতির সঙ্গে চলছে কোন কোন স্থানে আমরা বেড়াতে যাবো। শান্তিনিকেতন আর জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি যেতে সবাই একমত। তাই দর্শনীয় স্থানের তালিকার শুরুতেই স্থান পেল।

গত ৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রিজেন্ট এয়ারের একটি বিমানে কলকাতার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।   রিজেন্টের এ ভ্রমণটি ছিল খুবই আরামদায়ক। ২৫ হাজার ফুট উচুতে ৫০ মিনিট যাত্রার পর স্থানীয় সময় সাড়ে ১১টায় কলকাতা নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার।

বিমান বন্দরে আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে সেখান থেকে বিক্রম প্যাটেল ওরফে প্রসাদের পাজেরোতে চড়ে আমরা যখন কলকাতা শোভাবাজারে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় অমলেন্দু সরকারের আপ্যায়ন গেস্ট হাউসে, তখন দুপুর ২টা। সেখানে প্রবেশ করেই চমকে গেলাম আমরা। কারণ আর কিছু নয়, গেস্ট হাউসের তৃতীয় তলায় অসাধারণ চারটি নতুন কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়নি তপন দাদা যাবেন বলে; জানালেন গোপাল মাইতি। দাদা (অমলেন্দু সরকার) বলে গেছেন,‘এই রুম চারটে তপন দাদা উদ্বোধন করবেন। তাই এখনো কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়নি।  

ঝকঝকে তকতকে রুম। এসি লাগানো, নতুন এলইডি টিভি সব মিলেয়ে অসাধারণ পরিবেশ। দেখে মনে হয় যেন তারকা মানের কোন হোটেলে আছি আমরা। রুমে ঢুকেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আগে থেকেই আমাদের জন্য খাবার তৈরি তাই জানালেন গোপাল মাইতি। ফ্রেশ হয়ে ওপরের তলায় গেলাম দুপুরের খাবার খেতে।

আয়োজন দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। কে বলবে আমরা চট্টগ্রামে নেই। মলা মাছের তরকারি, সবজি, ডাল সেই এক খানা। না খেলে বলে বোঝানো যাবে না, অসম্ভব।

পরদিন শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) ভোর ৭টায় আমরা যাত্রা করলাম শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। শোভাবাজার থেকে বের হয়ে টোল রোড পেরিয়ে দিল্লি রোড হয়ে বর্ধমান জেলা। তারপর বীরভূম জেলায় প্রবেশ করে পৌঁছলাম বোলপুর শহরের কাছে অবস্থিত আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র শান্তিনিকেতনে। এর আগে যাত্রা বিরতি হয়েছিল বর্ধমান জেলার শক্তিগড় আমড়া মোড়ে। সেখানে সকালে নাস্তার পাশাপাশি খাওয়া হলো বিখ্যাত ল্যাংচা। এক অসাধারণ মিষ্টি।   

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তরাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমে কাটিয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মে এই আশ্রম ও আশ্রম-সংলগ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি সমুজ্জ্বল।

শান্তিনিকেতন চত্বরে নিজের ও অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনিন্দ্য স্থাপত্য সৌকর্যমণ্ডিত একাধিক ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আশ্রমনিবাসী বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের সৃষ্টিকর্মে সজ্জিত হয়ে এ আশ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল হয়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিনহার কাছ থেকে বিশ বিঘা জমি কিনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পায়ে হেটে বিশাল এলাকা দেখা সম্ভব নয়, তাই একটি টমটমে শান্তিনিকেতন এলাকা দর্শন শুরু হয় আমাদের। প্রথমেই নামলাম শান্তিনিকেতন ভবনের সামনে। কিন্তু বিধি বাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ভেতরে ক্লাস চলছে, তাই প্রবেশ নিষেধ।

এরপর কিছুদূর সামনে গিয়ে সড়কের ডান পাশে টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম রবীন্দ্র যাদুঘরে। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য আমাদের খুব বেশি সহায় হলো না। তবে একেবারে নিরাসও করেনি। মিউজিয়াম এলাকার একটি ভবনের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন জানালেন ৩০ মিনিট পরেই মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই দেখতে হলে দ্রুত ঘুরে আসতে হবে। দ্রুততম সময়ে সবকিছু অবলোকন করার চেষ্টা করেছি সবাই।

একে একে দেখে নিলাম বরীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, আসবাবপত্র, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ঐতিহাসিক সেই গাড়ি; যেটাতে চড়তেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যেক বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেওয়া আছে। আছে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়ার ছবিও।  

দেখা হলো শান্তিনিকেতনের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি শান্তিনিকেতন ভবন, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা, তালধ্বজ, দেহলি, তিন পাহাড়, নতুন বাড়ি। টমটমের চালক রাজ কুমার দাশ চিনিয়ে দিলেন সেই তালগাছ; যেটি নিয়ে জোড়াসাঁকুতে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘তাল গাছ একপায়ে দাড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে। ’

‘জানেন কি এটাই সেই তালগাছ, যেটা নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন ঠাকুরজি। ’ দেখা গেলো তালগাছটি সব গাছ ছাড়িয়ে এখনো মাথা উঁচু করেই দাড়িয়ে আছে। গাছটিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে মাটির ঘর; দেওয়া হয়েছে খড়ের ছাউনি। বোঝা গেল এই তাল গাছের কাহিনী শুনিয়েই পর্যটকদের মনযোগ আকর্ষণ করেন স্থানীয় গাইডরা। তবে ভাল একজন টমটম চালক পেলে গাইডের প্রয়োজন হবে না আপনার। যেমন আমাদের রাজ কুমার দাশ।

শান্তিনিকেতনে ঘুরতে ঘুরতে আমরা চলে গেলাম সঙ্গীত ভবনের মাঠে। আমলকি, হরতকী, শাল, মহুয়া সহ অনেক রকমের গাছের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। সবুজের মাঝে পড়ালেখার এমন দৃশ্য যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দুর্লভ। সেখানে কথা হয় সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী মৌমিতা ঘটকের সঙ্গে।

২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পার হওয়া বর্ধমান জেলার বাসিন্দা মৌমিতা জানালেন সঙ্গীত ভাল লাগে তাই এখানে পড়তে আসা। তবে চাইলেই এখানে পড়া যায় না। শান্তিনিকেতনে পড়ার স্বপ্ন সবার থাকে। তবে সে স্বপ্ন সবারই পূরণ হয় না। এজন্য প্রয়োজন কঠোর সাধনা।

মৌমিতা জানান, বিশ্বভারতীতে সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি, অসমীয়া, উড়িয়া, সাঁওতালি, মারাঠি, তামিল, উর্দ্দু, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, চীনা, ইতালিয়, তিব্বতী, রুশ, আরবী, ফারসী ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। তাছাড়া পাঠশালা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত বিশ্বভারতী থেকে নেওয়া যায়। শান্তি নিকেতনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুন্দর সুন্দর নামে সাজানো হয়েছে।

পাঠশালাকে বলা হয় মৃণালিনী, স্কুলকে পাঠভবন, একাদশ শ্রেণি থেকে পড়তে হয় উত্তর সদনে, গ্রাজুয়েট পর্যায়ে বিদ্যাভবন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়তে হয় শিক্ষাভবনে, সঙ্গীত, নাট্যকলা ইত্যাদির জন্য সঙ্গীতভবন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিনয়ভবন এবং কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি পড়ানো হয় শ্রীনিকেতনে।

ঘুরতে ঘুরতেই বিকেল তিনটা। দুপুরের খাওয়া হয়নি তখনো। তাই সেদিনের মতো শান্তিনিকেতন দর্শন সম্পন্ন করতে হলো আমাদের। ফেরার পথে শান্তিনিকেতন ট্যুরিস্ট লজে খাওয়া হলো। তারপর প্রসাদের গাড়ি ছুটলো কলকাতার দিকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৬
এমইউ/আইএসএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।