ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বাংলার প্রাণের কাছে

খাল-বিল শুকাচ্ছে, চারদিকে মাছ ধরার হিড়িক

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৬
খাল-বিল শুকাচ্ছে, চারদিকে মাছ ধরার হিড়িক ছবি- শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ

দু’ধারে সোনালি ধানের ঢেউ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে দ্বি-চক্রযান। আঁকা-বাঁকা, কাচা-পাকা রাস্তার কোল ঘেঁষে সরু মেঠোপথগুলো মিশেছে দূরের কোনো গাঁয়ে। পাকা ধানের ছড়া ক্ষেত ছাড়িয়ে নুয়ে পড়েছে মেঠোপথে, হাঁটার জো নেই!

দূর্গাপুর (নেত্রকোণা) থেকে ফিরে: দু’ধারে সোনালি ধানের ঢেউ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে দ্বি-চক্রযান। আঁকা-বাঁকা, কাচা-পাকা রাস্তার কোল ঘেঁষে সরু মেঠোপথগুলো মিশেছে দূরের কোনো গাঁয়ে।

পাকা ধানের ছড়া ক্ষেত ছাড়িয়ে নুয়ে পড়েছে মেঠোপথে, হাঁটার জো নেই!

দূর থেকে দেখা যায় টিনের চাল, খড়ের গাদা আর একপায়ে দাঁড়ানো তালগাছ। বাস-গাড়ির জানালা থেকে আমরা এইসব গাঁও-গেরাম দেখি, কখনও যাওয়া হয় না। ইচ্ছে জাগে, কোনো একদিন হুট করে নেমে পড়বো, বেগুন-কুমড়োর ক্ষেত পেরিয়ে পৌঁছে যাবো অজানা সেই গাঁয়ে। দ্বি-চক্র নেত্রকোণা সদর থেকে কলমাকান্দা হয়ে দূর্গাপুরের পথে। সদর থেকে ৪৫ কিমির পথ। কখনও রাস্তার পাশজুড়ে ছোট-বড় খাল-বিল, এর উপর বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর অন্যপ্রান্ত মিশেছে মেঠোপথে, সেখান থেকে আবার একই গল্প। পথ এগোয়। দূর থেকে হাত নাড়ে বেগুনি জামাপরা ডোবা-নালা, কেউবা পরেছে কলমিলতার চাদর।  

প্রকৃতিরাজ্যে অগ্রহায়ণ হলেও, শীত আগাম নিমন্ত্রণ নিয়ে চলে এসেছে। এর মধ্যেই খাল-বিল-নদীতে কমতে শুরু করেছে পানি। চিরায়ত নিয়ম, কার্তিক-অগ্রহায়ণ ধান কাটার মৌসুম। পাশাপাশি শুকাতে থাকে খাল-বিল-ডোবা। শীত জেঁকে বসার আগেই পানি সেঁচে মাছ ধরার কাজটি সেরে নেয় গাঁয়ের লোক। খাল-বিলে এখন তাই সৌখিন মাছ শিকারিদের ভিড়। অনেক অঞ্চলে ধান কাটা হয়ে গেছে, বড়রা ব্যস্ত মাড়াইয়ের কাজে। এই সুযোগে ঠেলাজাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পল্লীবালক আলম, রুহুল, সানাউলরা।  জাল নিয়ে ডোবায় নেমেছে আলম। বাকি দু’জন পাড়ে, সানাউলের দায়িত্বে কচুপাতা ঢাকা দেওয়া হাঁড়ি। পানি থেকে জাল তুলতেই লাফিয়ে উঠছে টেংরা-পুঁটি-চিংড়ি-খলসে। অন্যদু’জন হাত বাড়িয়ে মাছ নিয়ে রাখছে হাঁড়িতে। মাছ ধরায় কী আগ্রহ আর মনযোগ! কে জানে, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসেছে বোধহয়। খানিক বাদে দেখা যাবে, পিছন থেকে আচমকা এসে পড়ছে মায়ের সস্নেহ চপটাঘাত। এরপর কান ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

মা জানে কিনা, জিজ্ঞেস করতেই উত্তর না দিয়ে একগাল হাসি দিয়ে অন্যপাশে সরে গেলো। একহাড়ি মাছ নিয়ে মাকে চমকে দেওয়ার পণ। এই তো সোনালি শৈশব! ছোটবেলায় ধান উঠে গেলে দূরের মাঠে খেলতে যেতাম। মন-প্রাণ দিয়ে খেলায় মগ্ন, হঠাৎ পিঠে পড়তো একের পর এক চড়। মা হয়তো কোনো কাজ বা কিছু আনতে দিয়েছিলেন দোকান থেকে- বেমালুম ভুলে গিয়ে খেলায় মেতে উঠেছি, একেবারে হাতেনাতে ধরা। শেষ দৃশ্য, কান ধরে বাড়ি আনা, এরপর আরেক পর্ব মার- ‘আর কোনোদিন যাবি? না, যাবো না। ’ আহা, কী সব নানা রঙের দিনগুলি! 

পথ যতো এগোয় বেড়ে চলে সূয্যিমামার শাসন। ঘুরিয়ে-পেচিয়ে কয়েকবার দেখা হয়ে গেলো কংসনদীর সঙ্গে। নদীর শাখা-উপশাখার সঙ্গেও দেখা হলো। কলমাকান্দা বাজার অনেকটা ছাড়িয়ে এসেছি, দূর্গাপুর পৌঁছাতে বেশি দেরি নেই।  চোখ যায় হাঁড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বসে থাকা ছোট্ট খুকিমণির দিকে। ভাইধন তার জাল নিয়ে বিলে। কোমর থেকে কখনও নেমে পড়ছে গলা পানিতেও। পাড়ে ভিড়তেই হাঁড়ি হাতে ছুটে যাচ্ছে আদরের বোনটি। সযতনে মাছগুলো আগলে রাখছে সে। এই তো আমার গ্রাম-বাংলার চিরায়ত ছবি আর মায়া।

এই দৃশ্য মনে বাঁধিয়ে ভেসে চলি ডুবো জালতোলা ডিঙি নৌকায়। ভোরের অ‍ালো ফুটতেই বেরিয়ে পড়েছে নৌকা নিয়ে। আগের দিন বিকেল-সন্ধ্যায় জাল পেতে রাখা। জাল তুলতেই উঠবে- শোল, বোয়াল, দেশি পুঁটি, কই, মাগুর প্রভৃতি বিলের মাছ। কিছু যাবে গাঁয়ের বঁধূর মাটির হাঁড়িতে, বাকিটা স্থানীয় বাজার হয়ে শহরাঞ্চল।

এতো কেবল শুরু। উত্তরের হাওয়ার দাপট যতো বাড়তে থাকবে, ভিড় বাড়তে শুরু করবে খাল-বিলজুড়ে।  

নেত্রকোণা জেলার প্রধান নদীগুলোর মধ্যে সোমেশ্বরী, কংস, মগড়া, ধনু উল্লেখযোগ্য। সেইসঙ্গে পাশ্ববর্তী দুই জেলা হলো, হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। প্রতিবেশী জেলা হিসেবে খাল-বিল-হাওয়ের প্রবাহ নেত্রকোণাতেও পড়েছে। এসব যতোদিন রয়েছে, মাছধরার হিড়িকও থাকবে- দৃশ্যরা ফিরে ফিরে আসবে আলম, রুহুল, সানাউলদের ঠেলাজালে।

**গাঁও-গেরামের গান গাইতে গাইতেই মরতে চাই (ভিডিও)

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৬
এসএনএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।