‘ম্যাপ’ বা ‘মানচিত্র’-এর উৎপত্তি, ইতিহাস ইত্যাদিও কম রোমাঞ্চকর নয়। ‘ম্যাপ’ বা ‘মানচিত্র’ আজকের পর্যায়ে আসতে পেরিয়ে বহু পথ।
‘ম্যাপ’ বা ‘মানচিত্র’ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে বিস্তর। সেসব রীতিমতো জটিল ও কঠিন। তত্ত্ব-টীকা ও ভাষ্য ছাড়া এর গভীরে প্রবেশ করা দায়। তবু নিত্য প্রয়োজনীয় ‘ম্যাপ’ বা ‘মানচিত্র’ নিয়ে সহজে কিছু কথা বলার অবকাশ থাকে। একটি সংজ্ঞা কিছুটা সহজবোধ্য। তাতে বলা হয়েছে, ‘মানচিত্র হচ্ছে পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানকে প্রতীকের সাহায্যে বিধিবদ্ধ করে সেই জ্ঞান অন্যদের ব্যবহার উপযোগী করে পরিবেশন করার একটি পদ্ধতি। ’ এই পদ্ধতি যখন প্রতিবেশকে চিত্রায়িত করে চোখের সামনে তুলে ধরে তখন আর ‘ম্যাপ’ বা ‘মানচিত্র’-র সংজ্ঞা জানিয়ে দিতে হয় না।
‘ম্যাপ’ শব্দটি আদিতে ল্যাটিন ‘মাপ্পামুন্ডি’ শব্দটি থেকে এসেছে। ‘মাপ্পা’ অর্থ টেবিল-ক্লথ বা ন্যাপকিন আর ‘মুনডাস’ মানে পৃথিবী। যদিও শব্দটি ল্যাটিন তথাপি ম্যাপের পেছনে বাহাদুরি বেশি দেখিয়েছে চীনারা।
হাল আমলে মানচিত্র বলতে যা বোঝায়, হাজার হাজার বছর আগে প্রথমে তা মাথায় এসেছিল চীন দেশের মানুষের। চীন অনেক বিষয়েই পৃথিবীতে ফার্স্ট। মানচিত্র অঙ্কনেও। অতি প্রাচীন সভ্যতার দেশ চীনের ততোধিক প্রাচীন মানচিত্রের আজ আর কোনও অস্তিত্বই নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু দলিল-দস্তাবেজে, ঐতিহাসিক বিবরণে তার পরোক্ষ প্রমাণ এবং উদ্ধৃতি রয়েছে।
আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ১০২০ অব্দে তদানীন্তন চীন সম্রাটের কাছে একটি নতুন শহর পত্তনের জন্য আবেদন পেশ করা হয়েছিল। রাজাকে না জানিয়ে শহর বানানো সে যুগে একটি অকল্পনীয় ঘটনা বা দণ্ডনীয় অপরাধ। মজার ব্যাপার হলো, আবেদনের সঙ্গে প্রস্তাবিত শহরের একটি খসড়া নকশা বা মানচিত্রও যুক্ত করা হয়েছিল।
চীন এখনও যেমন, তখনও ছিল বিরাট দেশ। রাজার পক্ষে সশরীরে সর্বত্র গিয়ে সব কিছু দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তিনি মানচিত্র বা নকশার মাধ্যমে তাঁর সাম্রাজ্যের কোথায় কি হচ্ছে, সেটার আভাস পেয়ে থাকতেন। মানচিত্র ছিল সে রকমের পূর্বাভাস-জ্ঞাপক পদ্ধতি। দুঃখের বিষয়, প্রাচীন সেই মানচিত্রটি হারিয়ে গেছে। কিন্তু পরে প্রাপ্ত সেই আবেদনে তার উল্লেখ রয়েছে।
পরবর্তীকালে ঝাও বংশের আমলে শাসকদের আদেশ ছিল প্রত্যেক নগরের মানচিত্র তৈরি করতে হবে। সম্রাট রাজ্য পরিদর্শনে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকতেন রাজকীয় মানচিত্র আঁকিয়ের দল। একইভাবে ভারতবর্ষের গৌরবময় মুঘল সম্রাটদের সঙ্গেও থাকতেন একদল অঙ্কনশিল্পী। তাঁরা ভৌগোলিক বিবরণ ছাড়াও পশু-পাখি-গাছ-পালার ছবি আঁকতেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর আঁকিয়েদেরকে রাজপ্রাসাদের এক পাশে থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মুঘল সম্রাটদের সুন্দর সুন্দর ছবির অ্যালবাম এবং অনিন্দ্য-সুন্দর মিনিয়েচার চিত্রকর্ম এইসব আঁকিয়েদের অমর কীর্তি।
ভারতবর্ষ দখল করে ইংরেজরাও শাসন শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই স্থান, প্রাসাদ, ঘটনাবলী ইত্যাদির ছবি আঁকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতেন। প্রাচীন দিল্লি বা ঢাকা বা সিপাহী বিপ্লবের যুদ্ধচিত্র বলতে যা দেখা যায়, তার বেশির ভাগই ইংরেজ শিল্পীদের আঁকা। বর্তমানে তো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের ছবিও রক্ষিত হয়ে গেছে বড় বড় দেশগুলোর কাছে। উপরের ছবিই শুধু নয়, পৃথিবীর কোন অংশের মাটির নীচে কী আছে, সেটাও এখন আর তাদের অজানা নয়। আমাদের হাতের ফোনের গুগল ম্যাপও চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ, নগর, রাস্তা, ঘাটের মানচিত্র হাজির করছে।
পরিদর্শন বা ভূগোলের বাইরেও ম্যাপের বিরাট ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানের মতোই সুপ্রাচীন আমলেও শাসকবর্গ এবং আমলাতন্ত্রের কাছে মানচিত্র ছিল একটি শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার! সেই চীনেই গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে (১৯৯০) প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের সময় একটি বড়সড় ব্রোঞ্জের প্লেট পাওয়া যায়। তাতে যা লেখা ছিল, তার চীনা ভাষ্য হলো: ‘ঝাও য়ু তো’। বাংলা করা হলে তার অর্থ দাঁড়ায় ‘ঝাও-এর গোরস্তানের মানচিত্র’। বিশেষজ্ঞরা এই মানচিত্রটির তারিখ ধার্য করেছেন ‘খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক’।
পরে জানা গেল, খননকৃত এলাকাটি একটি সমাধিস্থল। সেখানে শায়িত সম্রাট ওয়াং ঝাও, তাঁর রানি এবং রক্ষিতারা। মানচিত্র বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মানচিত্রটির ব্রোঞ্জ-নির্মাণ জানান দিচ্ছে যে, চীন তখন রীতিমতো অগ্রসর ছিল মানচিত্র রচনায়। বিশেষ করে, এতে অঙ্কের ব্যবহার রয়েছে। অঙ্ক ছাড়াও রয়েছে বিবরণকে স্পষ্ট করার জন্য নানা সাঙ্কেতিক চিহ্ন। সেটা কাগজের যুগ ছিল না। তাই মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল ব্রোঞ্জ-ধাতুর ফলকে। বহু পরে এসেছে হাতে লেখা মানচিত্র এবং সর্বশেষে ছাপাখানা বা প্রেস চালু হলে পাওয়া যায় মুদ্রিত মানচিত্র।
পরবর্তী পর্ব
মানচিত্রে চৈনিক বাহাদুরি
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৭
এমপি/জেডএম