ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

মানচিত্রে চৈনিক বাহাদুরি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
মানচিত্রে চৈনিক বাহাদুরি মানচিত্রের গল্প।

দ্বিতীয় অধ্যায়
চীনের মানচিত্র বিষয়ক বাহাদুরির এখানেই ইতি ঘটে নি। বরং ধাতু থেকে বস্ত্রে এসে পৌঁছেছে মানচিত্র রচনায় চীনের কৃতিত্বের  প্রমাণ। হুনান প্রদেশে উৎখননকালে একজন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রের সমাধিতে রেশমি কাপড়ের ওপর আঁকা একটি মানচিত্র পাওয়া গেছে। চীনাদের অভিনব নানা কাজের মধ্যে মানচিত্র নিয়ে তাদের কাজ-কারবারও বেশ প্রসিদ্ধ।

ঘটনাটি পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে। পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, প্রাপ্ত মানচিত্রগুলো নির্ভুল, যথাযথ এবং বিস্তারিত।

৯৬ বাই ৯৬ সেন্টিমিটার মাপের একটি মানচিত্রে সঠিক দূরত্ব বোঝাবার জন্য স্কেল ব্যবহারও করা হয়েছে। যেমন, ১:১,৭০,০০০। কি ক্ষুদ্র পরিমাপের মধ্যে বিশাল ভূগোলকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে! মানচিত্রটিতে ওই এলাকার ভূচিত্র থেকে শুরু করে দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত সমগ্র এলাকা ধরা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মানচিত্রটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারেও প্রায়-নির্ভুল। তাছাড়া তাতে বিভিন্ন প্রতীক ও চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, প্রদেশের নাম চৌকা রেখার মধ্যে, শহর বৃত্তে। দুটি ঢেউ-খেলানো রেখায় নিদের্শ করা হয়েছে পাহাড়; রাস্তা সরু রেখায়; মাঝারি মোটা রেখায় নদী। গতিপথসহ ত্রিশটিরও বেশি নদী  আছে মানচিত্রটিতে। যে সমাধিক্ষেত্রে এটি পাওয়া গেছে, গবেষকরা তার কাল নিদের্শ করেছেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক।  

চীনের প্রাচীন মানচিত্র।  চীনের একই স্থানে কিছুদিন পরেই পাওয়া গেল আরো একটি মানচিত্র। প্রাপ্ত দ্বিতীয় মানচিত্রটি সামরিক। যুদ্ধের ঘটনাটি মানচিত্র আঁকার বারো-তেরো বছর আগেকার ঘটনা। সুতরাং বলা যায়, উদ্ধারপ্রাপ্ত মানচিত্রটি আসলে একটি যুদ্ধের স্মৃতি ও তথ্যবহ। এবং অতি প্রাচীন এহেন মানচিত্রটি তৎকালের কঠিন ও অপর্যাপ্ততার প্রেক্ষাপটেও রঙিনরূপে উপস্থাপিত। সেটাতে নদীর রঙ নীল, শহর লাল রেখায় ঘেরা, লাল-কালোর ত্রিভুজ দিয়ে বোঝানো হয়েছে ফৌজি ঘাঁটি।

অবাক হতে হয় প্রাচীন শিল্পীদের রঙের-বোধ বা কালার-সেন্স দেখে! গাণিতিক জ্ঞানও তাদের প্রশংসনীয়। আকার ছোট করে যুধ্যমান বাহিনীর আনুপাতিক শক্তি নিদের্শ করা হয়েছে। ত্রিভুজে রয়েছে সেনাপতির নাম। দেওয়াল ঘেরা দুর্গ, রসদভাণ্ডার, পর্যবেক্ষণ মিনার ইত্যাদি বোঝাতেও নানা সঙ্কেত ও চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। মানচিত্রটিতে, এমনকী যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তথ্য-বিবরণও গোপন নেই। চীনা ভাষায় কোনো কোনো শহরের পাশে যা লেখা রয়েছে তার বক্তব্য, ‘৩৫টি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে’। কোনটিতে বলা হয়েছে, ‘১০৮টি পরিবারের কেউই ফিরে নাই’। কিংবা ‘এখন কেউ বেঁচে নেই’। যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র এ আমলের মতো সে আমলেও প্রবলই চিত্র। মানচিত্র সে কথা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে।

২৯-২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাথরে খোদাই করে আঁকা মানচিত্র।  প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে বিশ্বের অন্যত্র কাদামাটির এমন ফলক পাওয়া গিয়েছে, যা বয়সের তুলনায় চীনের মানচিত্রের চেয়ে প্রাচীন; কিন্তু গুণগত বিচারে আদৌ তার কাছাকাছি নয়। বরং গবেষকদের ভাষায় বলা চলে যে, মানচিত্রটি ‘চীনের তুলনায় আদিম, কিন্তু অনুন্নত’।

মাটির ফলকে উৎকীর্ণ মানচিত্রের প্রচীনতম নমুনাটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বর্তমান ইরাকের নুজি নামক এলাকায়। এটির রচনাকাল ধার্য করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ। ফলকের মানচিত্রটিতে আকারে-ইঙ্গিতে জনপদ, নদী ও পাহাড়-পর্বত নির্দেশ করা হয়েছে। তাছাড়া ফসলের খেত এবং বৃক্ষবীথিরও সুচিহ্নিত নির্দেশ রয়েছে। রয়েছে বায়ুপ্রবাহের গতি। মানচিত্রের মাথা বা উপরের দিকটি ধরা হয়েছে পূর্ব, বাম দিকে উত্তর, নীচে পশ্চিম, কিন্তু রহস্যজনকভাবে দক্ষিণ দিকটি একেবারেই খালি, কোন কিছুরই উল্লেখ মাত্রও নেই।

প্রাচীন চীনের মানচিত্র।  বলে রাখা ভালো, বর্তমানকালে মানচিত্রের মাথাটিকে উত্তর দিক চিহ্নিত করার রেওয়াজ অতি সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। প্রাচীনকালে সব মানচিত্রেরই উপরের দিকটিকে চিহ্নিত করা হতো পূর্ব দিক বলে। এমনকী মধ্যযুগের খ্রিস্টানদের মানচিত্রও এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছিল না। তার কারণ একটাই, সূর্য ওঠে পূর্ব দিকে। এটাই ছিল সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিবেচনায় প্রচলিত মানদণ্ড। সূর্যকে কেন্দ্র করে তখন মানচিত্র লিপিবদ্ধ হতো। শুরু হতো উপরের দিক বা পূর্ব থেকে।

পরবর্তী পর্ব
ব্যাবিলনে মাটির ফলকের মানচিত্র

পূর্ববর্তী পর্ব
মাপ্পামুন্ডি থেকে আজকের ম্যাপ

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।