এই সূর্যের নিচে কর্মমুখর জীবনের গতিধারায় রাঙা এক মধ্যবয়েসি লোক। একটি বাঁশের লাঠি দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খড়ের স্তুপকে মেলে দিচ্ছেন তিনি।
শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নের মংড়াবস্তি’র সবখানেই তখন কর্মব্যস্ততা। এই গ্রামের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীরা এখন বাঙালি জীবনধারা সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
লক্ষ করা গেলো, গ্রামের পুরুষ সদস্যরা কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি গেরস্থালির কাজও করেন। আর নারীরা পার্শ্ববর্তী চা বাগানে গিয়ে কর্মী হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছেন বহু আগেই। সকাল ৮টায় তারা চা পাতা উত্তোলনের কাজে বেড়িয়ে পড়েন।
মাটির মসৃণ পথ ধরে যাওয়ার সময় দেখা গেলো, গ্রামেরই এক লোক ব্যক্তিগত কাজে মনোযোগী ও কর্মমুখর। খড়কুটো নিয়ে বেশ মাখামাখি! আপন মনে কাজ করে যাওয়ার তার এই মুহূর্তটি কাছে টানলো। বাড়ির শেষ মাথার একটি অংশ ঘিরে প্রবেশপথ।
সে পথ ধরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার পর দু’টি ছনের বাড়ি জীর্ণতার উদাহরণ টেনে ধরে জানান দিলো ওরা ভালো নেই। এই খড় নিংড়ানো ব্যক্তিটির নাম জাকব খাড়িয়া। উনি খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের লোক। দু-এক দিন বাদেই যে ‘বড়দিন’ তার কোনো আমেজ এখানে নেই।
ভরদুপুরে খড় শুকানোর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে জাকব খাড়িয়া বলেন, ‘এই খেড়গুলো (খড়) ভালো করে শুকিয়ে রেখে দিবো। এগুলো আমার দু’টি হালের গরুর জন্য প্রায় ৬ মাসের সংগ্রহ। ’
ক্ষেতের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিজের জায়গা রয়েছে দেড় কিয়ার (২০ কিয়ার-এ এক কাঠা)। আর বন্ধক দিয়েছি আরও দেড় কিয়ার। আমি দেড় কিয়ার জায়গায় দুই কিস্তির ফসল ফলাই। এই দেড় কিয়ার জমি থেকে প্রায় ত্রিশ মণ ধান হয়েছে। এই ধান দিয়ে সারা বছর যায় না। দু-এক মাস টান পড়ে। ’
মালতি, সাদা বালাম এবং শূন্যগুটি এই তিন জাতের ধান দুই কিস্তিতে উৎপাদন করেন বলে জানান জাকব।
হঠাৎ চোখ গেল উঠানের একপাশে পড়ে থাকা ডোলের (গোলা) দিকে। এটি বিশাল আকারের। এগুলো ধান রাখার জন্য উৎকৃষ্ট। কাছে গিয়ে দেখা গেল, পানির ট্যাংকের মতো বড় আর টুকরির মতো বাঁশগুলো নিপুণভাবে গাঁথা। ভেতরে সতেজ থাকার প্রলেপ।
ডোল সম্পর্কে জানতে চাইলে জাকব বলেন, এটি বাঁশের টুকরির মতো তৈরি করা হয়। তবে টুকরি থেকে পঞ্চাশ গুণ বড়। এটি তৈরি করার পর গোবর-মাটি দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। এমন একটি ডোল বানাতে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। এটি গ্রামাঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
ক্ষেত থেকে ধান কেটে এনে খড় ছড়িয়ে ধান এই ডোলে রাখি। তারপর সিদ্ধ করে চাল বানাই। এই ডোলের মধ্যে রাখলে ধান ভালো থাকে বলে জানান তিনি।
পরিবারের প্রসঙ্গে বলেন, তার স্ত্রীর নাম নীলমণি খাড়িয়া। স্ত্রী চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সন্তানরা পার্শ্ববর্তী স্কুলে লেখাপড়া করে।
কৃষিচাষ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, পানির অভাবে চাষ করতে পারি না। আলু, লালশাক, টমেটো ইত্যাদি ফলাই। খাওয়ার জন্য কিছুটা রেখে বাকিটা বাজারে বিক্রি করি। এতে হাতে কিছু টাকা পাই। এই দিয়ে কোনোমতে চলে যায় দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭
বিবিবি/আরআর