কিন্তু কারও সঙ্গে কারও অঙ্ক মেলে না। অঙ্ক বা পরিমাপ নিয়ে চলতে থাকে তীব্র বিবাদ।
বললেই তো হলো না! প্রমাণ দিতে হবে। হিসাব করে দেখানো হলো এর উচ্চতা ২৯ হাজার ফুট। সিকদার বাবু এ কাজের জন্য কৃতিত্বের অধিকারী। কিন্তু এভারেস্ট মেপেই হিমালয়ে থেমে থাকেনি ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়া’-এর জরিপের কাজ। সংস্থাটির লক্ষ্য হিমালয়ের ওপারে, নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতে। যেভাবেই হোক তিব্বতের একটি রূপরেখা, একটি মানচিত্র চাই-ই চাই।
এ লক্ষ্যে ১৮৬৫ সালে অনেক সম্ভাব্য অভিযাত্রীকে যাচাই করে তৈরি করা হয়। তারপর দুই বছর ধরে ভাষা ও জরিপের নানা জ্ঞান দিয়ে পাঠানো হয় নইন সিং এবং মণি সিং নামে দুইজনকে। তারা পরস্পরের নিকট আত্মীয়। দুইজনেই পাহাড়ি এলাকার লোক। নইন সিং ছিলেন শিক্ষক। যে কারণে তাকে বলা হয় ‘অ্যা পণ্ডিত এক্সপ্লোরার’। বহু বাধা-বিঘ্ন ডিঙিয়ে দুইজন ছদ্মবেশে হলেন তীর্থযাত্রী। এভাবেই তারা প্রবেশ করেন পৃথিবীর কাছে নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতে।
তিব্বতের পথে নেপালের সীমান্তে গিয়ে দুইজন দুই পথ ধরেছিলেন। মণি সিং চলে গিয়েছিলেন পশ্চিম দিকে। সেদিককার মানচিত্রের জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহ করে কিছুকাল পরেই তিনি ফিরে আসেন।
কিন্তু পাকা গোয়েন্দার মতো ছদ্মবেশী নইন সিং ঘুরতে ঘুরতে চলে যান খাস লাসায়, একেবারে তিব্বতের রাজধানী লাসায়। সেখানে পেলেন তিনি বিচিত্র কর্মকাণ্ডের সন্ধান। লাভ করলেন বিচিত্রতর অভিজ্ঞতা। তিনিই কিন্তু প্রথম স্থির করেন যে, লাসা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৪২০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এখন অবশ্য আরও পাকাপাকিভাবে মেপে সবাই জানতে পেরেছে যে, লাসা আসলে ৩৫৪০ মিটার উঁচুতে রয়েছে। একুশ মাস পরে তিনি বিপুল তথ্যসহ ভারতের দেরাদুনের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। তিব্বত সম্পর্কে এতো তথ্য কোনোদিনও কারও গোচরে ছিল না। নইন সিং নানাভাবে পুরস্কৃত হলেন তার কাজের জন্য। লন্ডনের রয়াল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির স্বর্ণপদকও মিলে যায় তার ভাগ্যে।
পরবর্তী দুই দশকে এভাবে আরও কিছু ভারতীয়কে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করে, জরিপের কাজ শিখিয়ে, নানা সাজে সাজিয়ে তিব্বতে পাঠানো হয়। নইন সিং-এর এক ভাতিজা কিষেণ সিংকেও পাঠানো হয়েছিল। তিনি চাচার চেয়ে এক কাঠি ওপরে। তিনি তিব্বত পেরিয়ে চিনে গিয়ে পৌঁছে যান। তিনি চিনে তো বটেই, দুর্গম ইরাবতী নদী সম্পর্কেও নানা রকমের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তার সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার হলো এই যে, তিনি ফিরে এসে বলেছিলেন তিব্বতের ‘সাংপো’ নদীই আসলে ভারতের ‘ব্রহ্মপুত্র’।
‘অসম্ভব’, বলে উঠেছিলেন সবাই। হাতেনাতে বিষয়টি প্রমাণের জন্য কর্তৃপক্ষ গোপনে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে পাঠিয়েছিলেন দার্জিলিং-এর এক বৌদ্ধ লামাকে। তার সঙ্গী করা হয় সিকিমের এক সার্ভেয়ারকে। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল সাংপো নদীতে ৪ ফুট লম্বা ৫০০টি গাছের গুঁড়ি ভাসিয়ে দিতে হবে। প্রতিদিন ভাসাতে হবে ৫০টি করে। লামা পথে পালিয়ে যান। সহযাত্রী সিকিমের ছেলেটি, যার নাম কিনথুপ, শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে দায়িত্ব পালনও করেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক দিন কেটে যায়। চিনে-তিব্বতে তিনি যখন কাঠের গুঁড়ি ভাসাচ্ছেন তখন ব্রহ্মপুত্রে তা ধরার জন্য আর কেউ নেই। সার্ভে পর্যবেক্ষণকেন্দ্র গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছিলেন যে, ওরা মারা গেছে কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। কিনথুপ দেরির কারণ জানিয়ে সার্ভে অফিসে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে চিঠিও সময়মতো পৌঁছায়নি। ফলে তার অভিযান কার্যত বিফলে যায়। অন্যদের মতো সম্মান ও স্বীকৃতি তার ভাগ্যে জোটে নি।
পূর্ববর্তী পর্ব
**রেনেলের 'বেঙ্গল অ্যাটলাস'
পরবর্তী পর্ব
**মানচিত্র থেকে গ্লোব
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৮
এমপি/জেএম